হরিণাকুণ্ডুর সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র
হরিণাকুণ্ডুর সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র
মাহবুব মুরশেদ শাহীন
নামকরণঃ- দেশের দক্ষিণ পশ্চিম জনপদের প্রবেশদ্বার খ্যাত ঝিনাইদহ জেলার একটি উপজেলা হরিণাকুণ্ডু। হরিণাকুণ্ডু নামকরন নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মত উপস'াপন করা হল-
আশির দশকের পূর্ব পর্যন্ত স'ানীয় লোকজনের নিকট হরিণাকুণ্ডুর পরিচিত ছিল হন্যেকুড়ো বলে। যেমন হরিণাকুণ্ডুর বাজারকে স'ানীয় লোকজনের নিকট হণ্যোকুড়োর হাট নামে বহুল প্রচলিত ছিল। এক সময় এখানে প্রচুর হরিণের বসবাস ছিল বলে প্রবীণরা আলাপচারিতায় প্রকাশ করে থাকেন।। সেই হরিণ থেকে হরিণা আর কুড়ো অর্থ রাশি-রাশি, গাদি-গাদি। সব মিলিয়ে হরিণের পাল যেখানে অভয় অরণ্য রুপে বসবাস করত সেই থেকে হন্যোকুড়ো নামটি প্রচলিত হয়েছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন। যা আধুনিক কালে হরিণাকুণ্ডু নামে পরিচিতি লাভ করে।
বৃটিশ বেনিয়া কোম্পানির নীল কুঠিয়াল ইংরেজ সাহেবের হিরণ নামক এক কন্যা কুণ্ডু (মিষ্টি) ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে প্রেম করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ইংরেজ সাহেব এতে অপমান ক্ষুব্ধ হয়ে এদেশ ছেড়ে চলে যান। কালক্রমে হিরণ-কুণ্ডুর প্রেমকাহিনী থেকে বর্তমান রূপ হরিণাকুণ্ডু পরিণত হয়েছে বলে একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে।
আবার ভিন্ন মতের সর্মথনকারীদের অভিমত- হন্যোকুড়ো নামকরণের মধ্যে দুটি শব্দ বিদ্যমান। প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল এটি হিরণ যার অর্থ স্বর্ণ আর অপরটি কুড়ো অর্থ কুণ্ডু। যা স'ানীয় ভাষায় রাশি-রাশি, গাদি-গাদি বা প্রাচুর্যের সমাহার বুঝান হত। প্রাচীনকালে হয়ত কোন এক সময় এখানে সোনার আমদানী রফতানি ব্যবসার প্রচলন ছিল। আর সেই থেকে হন্যোকুড়ো নামের উৎপত্তি হয়ে আধুনিক কালে হরিণাকুণ্ডু রূপ লাভ করেছে।
সর্বশেষ ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত ঐতিহ্যবাহী ঝিনাইদহ গ্রনে' হরিণাকুণ্ডুর নামকরণ অংশে বলা হয়েছে-“জমিদার হরিচরণকুণ্ডুর নাম অনুসারে হরিণাকুণ্ডু নামকরণ গৃহিত হয়েছে”। এবিষয়ে লোকমুখে প্রচলিত আছে-অভয়কুণ্ডু নামে এক ইংরেজ কর্মচারী অর্থ আত্মসাৎ করে জমিদারী খরিদ করেন। তিনি তার অত্যাচারী পুত্র হরিচরণকুণ্ডুর নামানুসারে হরিণাকুণ্ডু নামের প্রচলন করেন।
আয়তন ও অবস'ানঃ - হরিণাকুণ্ডু উপজেলা ২২৭.৬২ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট। উপজেলাটির দক্ষিণে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা, উত্তরে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা, পূর্বে শৈলকূপা উপজেলা এবং পশ্চিমে আলমডাঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা পরিবেষ্টিত। হরিণাকুণ্ডু, পারবতীপুর ও শুড়া তিনটি মৌজার সমন্বয়ে ২০০২ সালে হরিণাকুণ্ডু পৌরসভা গঠন করা হয়। পৌর শহরটির অয়তন ১৯.৯৭ বর্গ কিলোমিটার। সর্বমোট একটি পৌরসভা, ৮টি ইউনিয়ন, ৭৭টি মৌজা ও ১৩০টি গ্রামের সমন্বয়ে উপজেলাটি গঠিত।
জনসংখ্যাঃ- উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১,৯৭,৭২৩ জন। পুরুষ ৯৯,২৮৫ এবং মহিলা ৯৮,৪৩৮ জন। ধর্মীয় জনগোষ্ঠির হিসেবে ১,৮৮,৬৮৩ জন মুসলমান, ৮,৭৪০ জন হিন্দু, ২৫ জন খৃষ্টান এবং অন্যান্য সমপ্রদায়ের ২৭৫ জন নাগরিক রয়েছে। জনসংখ্যার ঘনত্বের হার ৮৬৯ জন ( প্রতি বর্গ কিলোমিটার)। হাউজ হোল্ডিং সংখ্যা ৪৮,০৫০টি। এছাড়া ১টি আদর্শ গ্রাম এবং আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতাধীন ১টি গুচ্ছ
গ্রাম ও কালাপাহাড়িয়ায় একটি আবাসন প্রকল্প রয়েছে। এখানকার জনগোষ্ঠির সাক্ষরতার হার ৪৮.৪০%।
জাতির শ্রেষ্ট সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিসংখ্যাঃ
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ২০০১ সালে প্র্রকাশিত তালিকায়- ১৩৮ জন।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ২০০৫ সালে ২১ মে প্র্রকাশিত তালিকায় আরো সংযুক্ত- ৬১ জন।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ২০০৫সালে ১ ডিসেম্বর প্র্রকাশিত তালিকায় আরো সংযুক্ত-১৬ জন।
====================================================
তিন তালিকা মিলে সর্বমোট- ২১৫ জন।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাঃ
নয়জন মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদদের নামের তালিকা ঃ
ক্রমিক নং নাম পিতার নাম গ্রাম
০১ শহীদ নবীছ উদ্দীন খোরমেদ আলী ফতেপুর
০২ ” ইজাল উদ্দীন বিশ্বাস মৃত ঃ আবজাল আলী বিঃ শ্রীপুর
০৩ ” মহাম্মদ আলী মালিথা মৃতঃ নাজের আলী মালিথা রঘুনাথপুর
০৪ ” তোয়াজ উদ্দীন মন্ডল মৃতঃ মঙ্গল মন্ডল ভাদড়া
০৫ ” এলাহী বক্স মৃতঃ আতোর আলী বড় ভাদড়া
০৬ ” দোস্তর আলী করিম মন্ডল কন্যাদহ
০৭ ” কাদের আলী মৃত ঃ গফুর আলী শাহ জোড়াদহ
০৮ ” রেজাউল ইসলাম মৃত ঃ গোলাম মহিউদ্দীন ভায়না
০৯ ” আমোদ আলী মৃত ঃ শুকুর আলী জোড়াদহ
সম্মানী ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা-২০৪ জন।
বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা- ৫,৩৪৮ জন।
বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা-২,৭৫৪ জন।
প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা- ১,২৫২ জন।
প্রতিবন্ধী শিক্ষা ভাতাভোগীর সংখ্যা-১০০ জন।
রেজিস্ট্রার্ড প্রতিবন্ধীর সংখ্যা- ৩০৫৪ জন (আইডি কার্ড প্রাপ্ত)।
ভিক্ষুক সংখ্যা- ৩৯৯ জন।
পুরুষ ভিক্ষুক- ১৫১ জন।
মহিলা- ২৪৮ জন।
(এ সকল ভিক্ষুকদর পূনর্বাসন কার্যক্রম চলমান)।
প্রশাসনঃ-ইংরেজ শাসন আমলে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হরিণাকুণ্ডুতে থানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন' অত্যাচারী জমিদারদের শোষন-শাসন বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় তাদের বিরোধিতার কারণে সে সময় এখানে থানা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী পারবতীপুর গ্রামের বিশিষ্ট কিছু নাগরিকবৃন্দ থানা প্রতিষ্ঠার জন্য জমিদানে সম্মত হলে ১৮২৭ সালে বর্তমান অবস'ানে থানা ও পাশাপাশি পোষ্ট অফিস প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ১৮৫৭ সালে ২.২৮ একর জমি থানা ও পোষ্ট অফিসের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। অবশেষে ১৮৬৩ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে হরিণাকুণ্ডুতে থানা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে হরিণাকুণ্ডু থানার সংগৃহিত রেকর্ড অনুয়ায়ি ১৯১৭ সালে ১ মার্চ যশোর পুলিশ অফিসের পিডিএসআই জনাব উজির উদ্দিন উক্ত স'ানে থানার ঘোষণাপত্র অনুমোদন দান করে স্টাফ প্রেরণের মাধ্যমে থানার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করান।
পুরাকৃতি ও ঐতিহাসিক নিদর্শনঃ- হরিণাকুণ্ডু, জোড়াদহ, ভায়না, ধূলিয়া, হিংগারপাড়া ও সোনাতনপুরে নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ, হরিশপুরে ফকির লালন শাহ’র ভিটে, লালন দীক্ষাগুরু দরবেশ সিরাজ সাই’র মাজার, পাঞ্জু শাহ’র মাজার, বেলতলায় দুদ্দু শাহ’র মাজার, রিশখালীতে বিপ্লবী বাঘা যতীনের পৈত্রিক ভিটা, কুলবাড়িয়ায় ফকির মাহমুদ বিশ্বাসের বাগান বাড়ি ও মাজার, দিগনগর কুমোর রাজার বাড়ির স্মৃতি চিহ্ন বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঐতিহাসিক ঘটনাঃ- বিপ্লবী বাঘা যতীন এবং কেরান রায় নামে দুজন দেশ প্রেমিক নাগরিক বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাদের নেতৃত্বেই এখানকার জনসাধারণ নীল চাষ প্রতিরোধ আন্দোালন গড়ে তোলেন।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানঃ- মসজিদ- ২৬০টি, মন্দির-১৬টি, গীর্জা-১টি, অন্যান্য উপাসনালয়- ১টি এবং ৫টি সৌধ রয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে- শ্রীপুর জামে মসজিদ, জোড়াদহ গম্বুজ মসজিদ, শীতলী জোয়ার্দার বাড়ি জামে মসজিদ ও হেফজখানা কমপ্লেক্স, পারবতীপুর থানা জামে মসজিদ, উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদ, হরিণাকুণ্ডু বাজার জামে মসজিদ, আন্দুলিয়া জামে মসজিদ, বলরামপুর জামে মসজিদ, কুলবাড়িয়া ফকির মাহমুদ বিশ্বাসের বাগান বাড়ি জামে মসজিদ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া পাবতীপুর বাজার মাতৃ মন্দির ও ভবানীপুর কালি মন্দির বিশেষ ভাবে পরিচিত।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ- প্রাথমিক বিদ্যালয়-১৪০টি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-১৩৫টি এবং রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়-৫টি।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ঃ-৪০টি। হরিণাকুণ্ডু সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ১টি, বেসরকারি এমপিও ভূক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়-৩৪টি এবং এমপিও বিহীন মাধ্যমিক বিদ্যালয়-৫টি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জোড়াদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৮৭২), হরিণাকুণ্ডু প্রিয়নাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৮৭২), হরিণাকুণ্ডু মাধ্যমিক (পাইলট) বিদ্যালয় (১৯৪৫) এবং শিশুকলি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯৯৫) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ।
কলেজঃ- ৬টি। সরকারি লালন শাহ কলেজ (১৯৯৭২)। এছাড়া ৫টি বেসরকারি কলেজ রয়েছে। এগুলো হলো- সালেহা বেগম মহিলা ডিগ্রি কলেজ (১৯৯৬), হাজি আরসাদ আলী ডিগ্রি কলেজ (১৯৯৫), জোড়াদহ কলেজ (২০০০), মান্দিয়া আইডিয়াল কলেজ (১৯৯৮), বঙ্গবন্ধু কারিগরী কলেজ (২০০৫)। মাদ্রসা-১২টি। এমপিও ভূক্ত ৭টি এবং এমপিও বিহীন ৫টি।
স্বাস'্য সেবাঃ- উপজেলাবাসির স্বাস'্য সেবা প্রদানের লক্ষে উপজেলা সদরে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি স্বাস'্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র-৬টি, স্বাস'্য সেবা কেন্দ্র-১১টি এবং ২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। উপজেলা হেডকোয়াটারে একটি সেবিকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও আছে।
কুটির শিল্পঃ তাত-৫০০টি, দর্জি-২৮০টি, হস্তশিল্প কেন্দ্র ৫টি, কাঠের শিল্প-১১৫, বাঁশের কাজ -১০,স্বর্ণকার ২০টি, কর্মকার-২৫।
প্রধান রফতানিযোগ্য ফসলঃ- ধান, চাউল, পান, পাট, খেজুর গুড়, চিনি, সবজী ইত্যাদি।
হাট বাজারঃ-২৬টি হাট বাজারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-হরিণাকুণ্ডু, পারবতীপুর, কুলবাড়িয়া, ভবানীপুর, জোড়াদহ, মান্দিয়া, ভায়না, রঘুনাথপুর, পাখিমারা, পোড়াহাটি, শাখারীদহ, সাতব্রীজ, নারায়নকান্দি, দখলপুর, শীতলী, চারাতলা, মথুরাপুর, ফলসী, হরিশপুর লালন বাজার, রিশখালি, সোনাতনপুর, ভালকী, চাঁদপুর, বন্যাতলা, সড়াবাড়িয়া নিউমার্কেট উল্লেখযোগ্য।
সাংস্কৃিিতক সংগঠনঃ-ক্লাব-২৫টি, গনগ্রন'াগার ১টি, সিনেমা হল ৩টি।( বর্তমানে সব বন্ধ) সাহিত্য সমিতি-৩টি, থিয়েটার গ্রূপ-৪টি, অপেরা গোষ্ঠী-১টি, ক্রীড়া ক্লাব ১২টি।
পত্রপত্রিকাঃ-লালনভূমি নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ২০১৫ সাল থেকে লালন শাহ’র জন্মভূমি হরিশপুর থেকে লালন স্মরণোৎসব উপলক্ষে বাৎসরিক ভাবে লালন নামে একটি স্মারক গ্রন' প্রকাশিত হয়ে আসছে। এছাড়া চলন্তিকা নামে একটি সাহিত্য সাময়িকী ২/১টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে অছে।
প্রধান পেশাঃ- কৃষি-৫৪.৯৩%, কৃষি শ্রমিক-২৫.৭৪%, মজুর শ্রমিক-১.৭২%, ব্যবসা বাণিজ্য-৭.৫৪%, চাকুরে-২.৩১% এবং অন্যান্য- ৭.৭৫%।
ভূমির ব্যবহারঃ-আবাদযোগ্য জমির পরিমান-২২,২৭৩ হেক্টর। বর্তমান আবাদযোগ্য-১৬৫০০ হেক্টর, অনাবাদী-৬২২৩ হেক্টর। স'ায়ী পতিত-৬০০ হেক্টর, জলাশয়-৮০০ হেক্টর। স'ায়ী ফল বাগান-৬০ হেক্টর, স'ায়ী বনায়ন- ১০০ হেক্টর, শহর অঞ্চল-৫০০ হেক্টর, গ্রাম অঞ্চলের ঘরবাড়ি- ৩০০০ হেক্টর, এছাড়া রাস্তা-স'াপনা-অবকাঠামো রয়েছে- ১১৬৩ হেক্টর জমি।
ভূমির ব্যবহারঃ- নীট ফসলী জমির পরিমান-১৬০০ হেক্টর, এক ফসলী- ১২০০ হেক্টর, দোফসলী- ৯৩০০ হেক্টর, তিন ফসলী-৬০০০ হেক্টরসহ মোট ফসলী জমির পরিমান দাড়ায় ৩৭৮০০ হেক্টর। এছাড়া গঙ্গা কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের আওতায় ৪০০০ হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পেয়ে থাকে।
ভূমির নিয়ন্ত্রনঃ-ভূমিহীন-২৩%, ক্ষুদ চাষি-৩৬% এবং মাঝারী চাষি-২৭%, এবং বড় চাষি-১৪% ভূমি নিয়ন্ত্র করে থাক্ে।
ভূমি ব্যবহারের নিবীড়তা-২২৯%, ব্যবহারের ঘনত্ব- ৪৩%।
নদী ও বাওড়ঃ- উপজেলাটির মধ্য দিয়ে কুমার ও নবগঙ্গা নামে দুটি নদী এবং নারায়নকান্দি, কাপাসহাটিয়া ও চাঁদপুরে তিনটি বাওড় অবসি'ত।
কুমার নদী- চুয়াডাঙ্গা জেলার হাটবোয়ালিয়ায় মাথাভাঙ্গা নদী হতে উদ্ভুত একটি নদী। বর্ষা মৌসূমে পানি পূর্ণ থাকলেও শুষ্ক মৌসূমে নদীটি শুকিয়ে যায। আশ পাশের অনেক বিলের পানি বয়ে আনার ফলে এ নদীর পানির রং ছিল অনেকটা কাল। এ কারণে স'ানীয় লোকজনের নিকট এ নদী কালো বিল বলে পরিচিত। উৎপত্তি স'ল থেকে কুমার বর্তমানে নবগঙ্গার প্রায় সমান্তরালে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। মাগুরার কাছে নবগঙ্গার সাথে মিলিত হয়ে মিলিত স্রোত নবগঙ্গা নামেই দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। কুমার এক সময় কালিগঙ্গা, ছাকু, হানু, মুচিখালি ইত্যাদি থেকে তার অধিকাংশ প্রবাহ পেত। উল্লেখিত সব কটি নদীই গড়াই এর শাখা। গঙ্গা কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে মাথাভাঙ্গা থেকে কুমারের উৎস মুখ এবং অন্যান্য নদী নালাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উৎস মুখগুলি বন্ধ করে দেওয়ায় কুমার বর্তমানে একটি ক্ষীণকায় নদীতে পরিণত হয়েছে। কেবল গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের প্রয়োজনাতিরিক্ত পানি এবং স'ানীয় বৃষ্টিপাতই এখন এই নদীর জল প্রবাহের প্রধানতম উৎস। হাটবোয়ালিয়ায় উৎপন্ন হওয়ার পর কুমার প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ঝিনাইদহ জেলার সীমানা বরাবর এসে শৈলকূপা উপজেলায় প্রবেশ করেছে এবং মাগুরা জেলা শহরের কাছে নবগঙ্গায় পতিত হয়েছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ প্রায় ১৪৪ কিলোমিটার। আলমডাঙ্গা, হরিণাকুণ্ডু, শৈলকূপা, শ্রীপুর, মাগুরা প্রভৃতি কুমার নদীর তীরবর্র্তী উল্লেখযোগ্য স'ান।
নবগঙ্গা- মাথাভাঙ্গা নদীর একটি শাখা, চুয়াডাঙ্গা শহরের নিকট এর উৎপত্তিস'ল। মাথাভাঙ্গা থেকে গঙ্গার নবরূপ- এভাবে নবগঙ্গা নামকরণ করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয। চুয়াডাঙ্গার কাছ থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হওয়ার পর মাগুরাতে কুমার এবং নড়াইলে চিত্রা নদীর জলাধারসহ এটি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব নদীতে পড়েছে। পূর্বে ইছামতির শাখা নদী ছিল। কিন' উৎস মুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে ভৈরব নদীর একটি উপ-নদীতে পরিণত হয়েছে। নদীটি নাব্য ও জোয়ারভাটা দ্বারা প্রবাহিত। উৎস মুখ হতে পূর্ব দিকে কিছু পথ যাওয়ার পর একটি বিলের মাঝে নবগঙ্গা পথরুদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৩০ সালে এই ভরাট মুখের সংস্কার করা হয়। কিন' এই সংস্কারের ফলেও নবগঙ্গার উৎস মুখের কোন পরিবর্তন হয়নি। এ স'ানটি গজনভী ঘাট নামে পরিচিত। চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলা অতিক্রম করে মাগুরার কাছে কুমার নদীতে যেয়ে মিশেছে। বস'ত মাগুরার পরবর্তী নবগঙ্গা কুমার নদীরই বর্ধিত সংস্করণ।
সামপ্রতিক সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, গড়াই মধুমতির মূল স্রোতের অধিকাংশই বরদিয়াতে নবগঙ্গা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীটির মোট দের্ঘ্য ২৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলার অংশ ২৬ কিলোমিটার। নবগঙ্গার সমগ্র পথ আঁকা বাঁকা হলেও ভাঙ্গন প্রবণ নয়। চুয়াডাঙ্গা থেকে মাগুরা পর্যন্ত পথ অনাব্য এবং জলজ উদ্ভিদে পরিপূর্ণ। তবে বর্ষা মৌসূমে দুই তিন মাস নৌকা চলাচলের উপযোগি থাকে। মাগুরার নিম্ন অঞ্চল সারা বৎসরই নাব্য। মাগুরা পর্যন্ত এই নদীর গড় প্রস' ২০০ মিটার এবং পরবর্তী
অংশের গড় প্রস' ৩০০ মিটার। মাগুরা পরবর্তী অংশ নিয়মিত জোয়ারভাটা দ্বারা প্রভাবিত। জোয়ারভাটার গড় পরিসর প্রায় ১ মিটার।
চুয়াডাঙ্গা থেকে গাজীরহাট পর্যন্ত বিভিন্ন স'ানে পাম্পের সাহায্যে এই নদীর পানি সেচকার্যে ব্যবহারিত হচ্ছে। মাগুরাতে একটি সেতু নির্মান করে এর সাহায্যে উজান অংশে সেচ কার্য পরিচালনা করা হচ্ছে। কালাচাঁদপুর থেকে গাজীরহাট পর্যন্ত নদীর ডানতীরে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের আওতায় এই জলকাঠামো এবং বাঁধটি ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে।
ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, বিনোদপুর, সূত্রাজিতপুর, নওহাটা, শিংগিয়া, নলমি, রায়গ্রাম লক্ষীপাশা, লোহাগড়া, বরদিয়া, গাজীরহাট প্রভৃতি নদীর তীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স'ান।
প্রধান ফসল- ধান, পাট, কলা, গম, পান, ভূট্রা, মসূরী, ছোলা, মরিচ, পিয়াজ, রসুন, সরিষা, বেগুন, আলুসহ বিভিন্ন প্রকারের সবজী চাষ করা হয়।
ফলঃ-আম, কাঠাল, নারিকেল, লিচু, কলা, বেল, তাল, সবেদা, কুল, পিয়ারা, জামরুল, কালো জাম, জাম্বুরা, বাতাবী লেবু ও কাগজী লেবু উল্লেখযোগ্য।
বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত ফসলঃ-তিসি, তিল, রাই সরিষা, কাউন, যব, বার্লি ও তামাক উল্লেখযোগ্য।
যোগাযোগঃ-উপজেলাতে ২৫০টি ছোট বড় রাস্তা রযেছে। যার দের্ঘ্য ৫১৩ কিলোমিটার। ২২০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৫৫ কিলোমিটার সলিং ও এইচএসবি এবং অবশিষ্ট ২৩৮ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা।
যানবহনঃ- বাস, ট্রাক, গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি, ভ্যান, পাখি ভ্যান (ইঞ্জিন চালিত), ইজি বাইক, আলমসাধু, নসিমন, করিমন, লাটা হাম্বার, ট্রলি, ট্রাক্টর, পিক-আপ ইত্যাদি।
বিলুপ্ত প্রায যানবহনঃ- পাল্কী, ডুলি, ঘোড়ার গাড়ি।
কারখানাঃ- চাউলের কল-৫৭টি, বরফ কল ২টি, বেকারী-৩টি, সমিল-১০টি, ওয়েল্ডিং ১১টি। এছাড়া অর্ধ ডজনের মত কারখানাতে চায়না ইঞ্জিনের সাথে স'ানীয় প্রযুক্তি যোগ করে বিভিন্ন গ্রামীণ পরিবহন খ্যাত যানবহন তৈরী করা হচ্ছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান- ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনাসহ আর্থিক লেনদেনের জন্য বেশ কয়েটি সরকারি বেসরকারি ব্যাংক গড়ে উঠেছে। সরকারি ব্যাংকগুলির মধ্যে সোনালী, জনতা , অগ্রণী, কৃষি এবং বেসরকারি
ব্যাংকের মধ্যে ডাচ-বাংলা, গ্রামীণ, ব্রাক ব্যাংক উল্লেখযোগ্য। এসকল ব্যাংক উপজেলা শহর ছাড়াও ইউনিয়ন এমন কি গ্রামীন জনপদ পর্যন্ত বিস-ৃত রয়েছে।
বিদ্যুৎ ব্যবস'াঃ- নব্বই দশকের মধ্যবর্তী সময় হতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় উপজেলা সদরের বাইরে বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাভূক্ত হওয়ার পূর্ব
পর্যন্ত উপজেলায় ১৬৪ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন নির্মানের ফলে ১৯% এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এসময় ৫১২৭ জন গ্রাহক (১২.৪৬%) বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পল্লী বিদ্যুতের মাধ্যমে ৬৯৯ কিলোমিটার লাইন নির্মানের ফলে ৮৩% এলাকায় বিদ্যুৎ সরবাহের মাধ্যমে ৩৬,৩৮০ জন গ্রাহককে ( ৯০%) বিদ্যুৎ সরবাহ নিশ্চিত করা হয়। ২০১৮ সালের মার্চের মধ্যে ৮৩৬ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মানের মাধ্যমে উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুৎ সরবাহ নিশ্চিত করার মাস্টার প্লান বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। উপজেলা সদরের দিগগনর এলকাতে সমপ্রতি ৩৩ কেভি ক্ষমতা সম্পন্ন একটি সাব স্টেশন নির্মানের মাধ্যমে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ অনেকাংেশে নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হয়েছে।
কৃতিমান ব্যক্তি-
মহান সাধক ফকির লালন শাহঃ (১৭৭২-১৮৯০)
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী মহান সাধক ফকির লালন শাহ ১৭৭২ সালে তৎকালিন বৃহত্তর যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার হরিণাকুণ্ডু থানার হরিশপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দরিবুল্লাহ দেওয়ান এবং মাতার নাম আমিনা খাতুন। পিতামহ ছিলেন গোলাম কাদির দেওয়ান। দরিবুল্লাহ দেওয়ানজির তিন পুত্র আলম, কলম এবং লালন।
১৭৭২-১৭৭৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিকৃত ভারত বর্ষের রাজধানী হয় কোলকাতা। ঠিক এই সময় স্যার জোসেফ প্রিস্টলি (১৭৩৩-১৮০৪) নামক এক ইংরেজ ধর্মযাজক, রসায়নবীদ ও দার্শনিক অক্সিজেন আবিষ্কার করে পৃথিবীবাসিকে চমকিয়ে দেন। আর অধিকাংশ গবেষকদের মতে ফকির লালন শাহ এ সময় কালেই জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তী কালে তিনি হয়ে ওঠেন স্বতন্ত্র ধারার এক মহান সাধক পুরুষ। লালন ছিলেন মানবতাবাদী। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চে স'ান দিয়ে ছিলেন। অসামপ্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেন। তার গান ও দর্শন যুগ যুগে প্রভাবিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অ্যালেন গিলবার্গের মত খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তার রচিত সহস্রাধিক গান মরমী চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ায় স'ানীয় লোকেরা এটিকে দেহতত্ব বা ভাব গান বলে আখ্যায়িত করে থাকে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্ব প্রথম লালন শাহকে মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ২০০৪ সালে বিবিসি’র শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচনের তালিকায় ফকির লালন শাহকে ১২তম স'ান দান করা হয়েছে।
এখানে একটি বিষয় বিশেষ ভাব্ সে্মরণ রাখা প্রয়োজন- লালন যখন জন্ম গ্রহণ করেন তখন উপমহাদেশে রাজনীতি ইংরেজ বেনিয়া কর্তৃক সম্পূর্ণ রুপে নিয়ন্ত্রিত। কুটকৌশলী ইংরেজরা হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে জাতিগত উস্কানী ছড়িয়ে দিয়ে বিভেদ সৃস্টিতে ছিল বিশেষ তৎপর। এক পক্ষকে আপন করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার নীতি অবলম্বন করে তারা। এ নীতিতে ইংরেজরা বলতে গেলে সম্পূর্ন রুপে সফলকাম হয়েছিল। হিন্দু সমপ্রদায় ইংরেজদের প্রিয়ভাজনে পরিণত হয়ে শিক্ষা, ব্যবসা বানিজ্যের মাধ্যমে অর্থ প্রতিপত্তি লাভ করে মুসলিমদের দাবি রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ফলে মুসলিম সমপ্রদায় শিক্ষা ব্যবসা বনিজ্য অর্থ সব দিক থেকে নিদারুন ভাবে পিছিয়ে পড়ে। এমন সময় সমগ্র বাংলার বুক জুড়ে অভিশাপ রুপে নেমে আসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। সবত্রই দেখা দেয় দুর্ভিক্ষের চরম হাহাকার। অভাবের তাড়নায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হয় বিপন্ন মানুষ। দরিবুল্লাহ দেওয়ানের পরিবারও এ করাল গ্রাসের থাবা মুক্ত হতে না পেরে নিজের জমি জায়গা বিক্রি করে পরিবার পরিজনের আহার জোগাতে থাকেন।
তিন ভায়ের মধ্যে বড় ভাই আলম জীবিকার তাগিদে কলিকাতা চলে যান। কৈশরে পিতার মৃত্যুর পর মেজো ভাই কলম পিতার রেখে যাওয়া সামান্য কিছু জায়গা জমি চাষ করে কায় ক্লেষে সংসার পরিচালনা করতে থাকেন। ছোট ভাই লালন ছিল সঙ্গীত প্রিয়, সংসার বিমূখ এক কিশোর। কুলবেড়ে হরিশপুর অঞ্চলে কোথাও গানের আসরের সংবাদ পেলে লালন সেখানে যেয়ে হাজির। কিন' অভাব গ্রস' মেজো ভাই কলম ছোট ভায়ের এ ছন্নছাড়া স্বভাবকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ভাই ভাবী মিলে সংসারের কাজে আত্ম নিয়োগ করার জন্য প্রতি নিয়ত লালনকে তাগিদ দিতে থাকে। কিন' উদাসীন লালন এসবে কর্ণপাত করতে নারাজ।
হরিশপুরের প্রবীণ ব্যক্তি মরহুম মুন্সী আব্দুল আজিজ ব্যক্ত করেন যে, ভায়ের অভাবের সংসারে বসবাসকালিন সময়ে ২১/২২ বছর বয়সে লালন পক্সজ্বরে আক্রান্ত হন। পরিবারের লোকেরা সেবা শুশ্রূষা করলেও নানা খুটা শুনতে শুনতে গুরুতর অসুস'্য লালন একদিন রাতের আঁধারে সকলের অজান্তে উদ্দশ্যহীন ভাবে বাড়ি ছেড়ে অজানার পথে বের হয়ে পড়েন। গুরুতর অসুস'্যতার কারনে বাড়ির অদূরে থানা ঘাটের নিকটবর্তী বাটিকামারির বিলের ধারে বটতলায় পৌছে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। প্রাতঃকালে একই পাড়ার রমনী সিরাজ সাঁই পত্নী বিলের ধারে পানি আনতে যেয়ে মুমূর্ষ অবস'ায় এক যুবককে পড়ে থাকতে দেখে গৃহে ফিরে স্বামীকে বিষয়টি অবহিত করেন। মানব দরদী সিরাজ সাই ক্ষীণকণ্ঠে গোঙানীরত লালনকে পাঁজাকোলা করে নিজ গৃহে নিয়ে এসে সেবা শুশ্রূষা করতে থাকেন। সিরাজ দম্পতির আন্তরিক সেবায় কিছু দিনের মধ্যে তিনি সুস'্য হয়ে উঠলেও তার একটি চোখ চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারায়।
রোগ মুক্তির পর সিরাজ সাই লালনকে তার নিজ গৃহে ফিরে যেতে নির্দেশ দিলে, সে বাড়ি ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি বলেন, যে সংসারে বিপদে আপন ভাইও পর হয়ে যায়, সে সংসারে আমি আর ফিরবো না। আপনি আমার নবতর জীবন দান করেছেন। আমি আপনার অধীন দাস হয়ে চিরদিন আপনার সেবা করতে চাই। আপনি দয়া করে আমাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করুন। কিন' সিরাজ সাই লালনের সামাজিক অবস'ান এবং বংশীয় মর্যদার কথা চিন্তা করে তাকে মুরিদ করে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, সে বিদ্যা বুদ্ধিহীন একজন নগন্য মানুষ মাত্র। সে কারনে গুরূপদের অযোগ্য। বরং তাকে একজন ভাল কামেল পীরের নিকট মুরিদ হওয়ার নিদের্শনা প্রদান করেন। কিন' নাছোড়বান্দা লালন সিরাজ দম্পতির আপত্য স্নেহ মমতা বাঁধনে চিরতরে আবদ্ধ হয়ে পড়ায় সিরাজ গৃহ ত্যাগ করে সে আর নিজ গৃহ কিম্বা অন্য কোথাও ফিরে যায়নি।
সংসার বিমুখ মিঠেকণ্ঠ লালনের মধ্যে অমিত সম্ভবনাময় প্রতিভার ঝিলিক দেখতে পেয়ে সিরাজ সাই পুত্র স্নেহে নিজ বাড়িতে পরম আদরে তাকে স'ান করে দেন। লালনও এরকম পিতৃতুল্য গুরু পেয়ে সর্বক্ষণ সিরাজ সাই’র একান্ত সান্নিধ্যে সময় অতিবাহিত করতে থাকেন। যে কারনে লালন তার অগনিত গানে দরবেশ সিরাজ সাইকে সশ্রদ্ধ চিত্তে সমরন করেছেন। লালন শাহ’র একটি গান এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে সমরন যোগ্য-
“গুরু তুমি পতিত পাবন পরম ঈশ্বর,
অখন্ড মন্ডলা কারং ব্যপ্তম জগৎ চরাচর।
ব্রক্ষ্মা বিষ্ণু শীব এই তিনে,
ভজে দয়াল নিশি দিনে।
আমি জানি না হে তোমা বিনে,
ওহে গুরু পরাৎপর।
ভজে যদি না পাই তোমায়,
এ দোষ আমি দিব বা কার।
দুটি নয়ন রাখি তোমার উপর,
যা কর তুমি এবার।
আমি লালন এক ষেঁড়ে
ভাই বন্ধু নাই আমার জোড়ে
ভূগে ছিলাম পক্সো জ্বরে
দরবেশ সিরাজ সাই করলেন উদ্ধার।”
এ গান থেকেই সপষ্ট বুঝা যায় লালন ও তার দীক্ষা গুরু দরবেশ সিরাজ সাই’র প্রকৃত পরিচয়। হরিশপুরে লালনের বসত ভিটার সন্নিকটে থানা ঘাটের অদূরবর্তী বাটিকামারি বিলের ধারে পক্সজ্বরে আক্রান্ত লালন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলে দরবেশ সিরাজ সাই যে তাকে উদ্ধার করে সেবাদানের মাধ্যমে সুস'্য করে তোলেন। উপরোক্ত গানটির মাধ্যমে সে কথা গভীর শ্রদ্ধাভরে তিনি স্মরন করেছেন। কিন' সামিপ্রক কালে আকাট্য যুক্তি এবং শক্তিশালী তথ্য প্রমান থাকার পরও উপরোল্লেখিত লালন গীতিটির বিকৃতি ঘটিয়ে দরবেশ সিরাজ সাই’র স'লে মলম শাহ সংযোজন করা হয়েছে। যা সত্য ইতিহাস বিকৃতির এক জঘন্যতম অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে সকল লালন জীবনীকারগন ২১/২২ বছর বয়সী যুবক লালনকে ছেউড়িয়ার কালিনদীর ধারে অজ্ঞান অবস'ায় পড়ে থাকার তথ্য উপস'াপনের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছেন, তারা কোন ভাবেই উপরি-উক্ত লালন গীতিটিতে উল্লেখিত দরবেশ সিরাজ সাইকে ছেউড়িয়াতে উপস'াপন করার মত কোন যুক্তি তুলে ধরতে পারেননি। সে কারনে লালনের আত্ম পরিচয় তথ্য সম্বলিত সঙ্গীতটির বিকৃতি ঘটিয়ে মলম শাহ করলেন উদ্ধার তথ্যটি উপস'াপন করা হয়েছে। ঠিক এমন আর একটি সঙ্গীতে বলা হয়েছে-
সিরাজ সাঁই ফকিরের বানী
বুঝবি লালন দিনি দিনি,
শক্তি ছাড়া ভাবুক যিনি,
সে কি পাবে গুরুপদ॥
সাঁই সিরাজের হকের বচন,
ভেবে কহে অবোধ লালন,
দায়েমী নামাজী যে জন
সমন তাহার আজ্ঞাকারী ॥
অথচ লালন শাহ’র অসংখ্য গানের একটিতেও সিরাজ সাই ব্যতিত মলম শাহ কিম্বা অন্য কারুর নাম ভনিতা আকারে উল্লেখ করার কোন তথ্য প্রমানাদি অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি।
এছাড়া লালন ও তাঁর দীক্ষা গুরু দরবেশ সিরাজ শাহ’র জন্মস'ান হরিশপুর এ সম্পর্কীয় প্রাচীনতম অকাট্য বিবরণ পাওয়া যায। ঐতিহাসিক ও গবেষক মৌলভী আব্দুল ওয়ালী লিখিত একটি প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন-
“অহড়ঃযবৎ ৎবহড়হিবফ ধহফ সড়ংঃ সবষড়ফরড়ঁং াবৎংরভরবৎ যিড়ংব দউযুঁধহ' ধৎব ঃযব ৎধমব ড়ভ ঃযব ষড়বিৎ পষধংংবং ধহফ ংঁহম নু ইড়ধঃসবহ ধহফ ড়ঃযবৎং, ধিং ভধৎ ভধসবফ 'খধষড়হ ঝযধয'. ঐব ধিং ধ ফরংপরঢ়ষব ড়ভ ঝরৎধল ংযধয ধহফ নড়ঃয বিৎব নৎড়হ ধঃ ঃযব ারষষধমব ঐধৎরংযঢ়ঁৎ, ঝঁন-উরারংরড়হ- ঔবহরফধয, উরংঃৎরপঃ-লবংংড়ৎব.চ
[ঙহ ংড়সব পঁৎষড়ঁং ঞবহবঃং ধহফ ঢ়ৎধপঃরপবং ড়ভ পবৎঃধরহ পষধংং ড়ভ ঋধয়ঁরৎং রহ নবহমধষ-ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব অহঃযৎড়, ঢ়ড়ষড়মরপধষ ঝড়পরবঃু ড়ভ ইড়সনধু-১৯০০. ঠড়ষ, ঘ০-৪: ৎবধফ ড়হ ৩০, ৯,১৮৯৮.]
অর্থ-“আর একজন বিখ্যাত গীতিকার যার ধুয়োগান নিম্ন শ্রেণির লোকদের অনুরাগের বিষয়। এ গান নৌকার মাঝিরা এবং অন্য সকলে গেয়ে থাকেন। ইনি হচ্ছেন বহু বিখ্যাত লালন শাহ্। তিনি ও তার পীর সিরাজ শাহ্ উভয়েই যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার অধীন হরিশপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।”
১৮৯৮খ্রিঃ শৈলকূপার সাব-রেজিস্ট্রার, প্রত্নতত্ত্ববীদ, ঐতিহাসিক ও এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য মৌলভী আব্দুল ওয়ালি একটি প্রবন্ধে উপরোল্লেখিত তথ্যটি প্রদান করেন। ১৯০০ খিষ্টাব্দে বোম্বের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে এটি প্রকাশিত হয়। মৌলভী আব্দুল ওয়ালী হরিণাকুন্ডু থানার পার্শ্ববর্তী শৈলকূপা থানার সাব-রেজিষ্ট্রার ছিলেন। সে সময়ে হরিণাকুন্ডুতে সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস না থাকায় ভূমি রেজিষ্ট্রি সংক্রান্ত কাজে হরিণাকুন্ডুবাসি অহরহ শৈলকূপাতে যাতায়াত করতেন। শৈলকূপা থানাটি হরিণাকুন্ডু থানা সংলগ্ন হওয়ায় আব্দুল ওয়ালী সাহেব প্রদত্ত তথ্যটি অধিকতর নির্ভূল এবং গ্রহণযোগ্যতার মাফকাঠিতে উত্তীর্ণ বলে সচেতন সুধি সমাজের অভিমত।
অধ্যাপক আবূ তালিব লালন পরিচয় সম্বলিত এক গবেষনায় উল্লেখ করেন-১৮৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি তৎকালিন যশোর জেলার শৈলকূপা এলাকাধীন (বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার আলমডাঙ্গা গ্রাম) পরমানান্দপুর মৌজায় একটি আঁখড়াবাড়ি নির্মানের জন্য পাট্রা দলিলের মাধ্যমে জমি খরিদ করেন। দলিলে লালন শাহ’র পরিচয় কলামে বিবরণ দেওয়া হয়েছে এভাবে- শ্রী যুক্ত লালন সাই, পিতা সিরাজ সাই, জাতি মুসলিম, পেশা- ভিক্ষা। ঠিকানার বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছেঃ সাকিন-ছেউড়ে, ভ্রামিপুর, ইস্টাসন ভালকো, ছব-রেজিস্ট্রারিঃ- কুমারখালি ইত্যাদি। দলিলে লালনের নিজ হস্তের দস্তখাত আছে। এখানে লালন নিজের প্রয়োজনেই তার পরিচয় ব্যক্ত করেছেন।
হরিশপুরের পূর্ব পাড়া সংলগ্ন বেলতলা গ্রামের ঝড়- মন্ডলের পুত্র দুদ্দু শাহ লালন শাহ’র প্রধান অন্তরঙ্গ ভক্ত ছিলেন। তৎকালিন যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার শৈলকুপা থানার আলমডাঙ্গা গ্রামের পরমানন্দপুর মৌজাধীন এলাকায় জমি খরিদ করে লালন শাহ’র একটি আঁখড়াবাড়ি নির্মান করেন। এ আঁখড়ার তত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন লালন শাহ’র অন্যতম শিষ্য শুকুর শাহ ফকিরের উপর। এই শুকুর শাহ’র আঁখড়াতে বসে দুদ্দু শাহ একদা এক নিরালাক্ষণে লালনের নিজ মুখে বর্ণিত আত্মবিবরণী শুনে ছিলেন, যা তিনি এক পঁথিতে তা লিপিবদ্ধ করে যান। এখানে দুদ্দু শাহের ভাষায় তা উদ্ধৃত করা হলো-
আলমডাঙ্গা গ্রামে শুকুর শাহৰ আশ্রমে
আরজি করিনু আমি অতীব নির্জনে
*************************
কহ কিছু আত্মকথা এদাসে বুঝাইয়া
এত শুনি দয়াল চাঁদ মোর পানে চায়।
মৃদু হাসি এই দাসে যাহা কিছু কয়॥
মুক্তাছার তার কিছু বর্ণনা করিব।”
ইত্যাদি।
এসময় লালন শাহ প্রধান ভক্ত দুদ্দু শাহকে যে বংশ পরিচয় দান করেছিলেন তারই ভাষায় তা উদ্ধৃতি করা হলো-
ধন্য ধন্য মহামানুষ দয়াল লালন সাঁই
পতিত জনার বন্ধু তাঁর গুন গাই।
********************
এগার-শো উন আশি কার্তিকের পহেলা
হরিশপুর গ্রামে সাঁইর আগমন হৈলা।
যশোর জেলাধিন ঝিনাইদহ কয়
উক্ত মহাকুমাধিন হরিশপুর হয়।
গোলাম কাদের হন দাদাজি তাহার
বংশ পরস্পরা বাস হরিশপুর মাঝার
দরীবুল্লা দেওয়ানজি তার আব্বাজির নাম
আমিনা খাতুন মাতা এবে প্রকাশিলাম।
***********************
বারশত সাতানববই বাংগালা সনেতে
পহেলা কর্তিক শুক্রবার দিবান্তে।
সবারে কাঁদায়ে মোর প্রাণ দয়াল
ওফাৎ পাইল মোদের করিয়া পাগল।
ফকির লালন শাহ যে হরিশপুইে জন্মগ্রহণ করেন তার আর একটি বড় প্রমান রয়েছে। হরিশপুরের পূর্বপাড়া সংলগ্ন ঠাকুরতলায় (বটবৃক্ষতলে) ধূয়োজারি গানের এক প্রতিযোগিতায় সমকালিন খ্যাতিমান লোক কবি পাগলা কানাই(১৮০৯-১৮৮৯) অংশ গ্রহণ করেন। তিনি সেই প্রতিযোগিতায় একটি ধূয়ো গানে উল্লেখ করেন-
ধুয় গানে হবে পাল্লা
মুখে সবে বর আল্লা
এই আমার যশোর জিলা
হরিণুকুণ্ডু থানাতে
গ্রামের নাম হরিশপুরী
খাটবে নাকো জারিজুরি
বহু লোকের মাতব্বরী
আসরে আইছি কথা জানাতে
হরিশপুর তার জন্ম মাটি
লালন শাহ ফকির খাঁটি
জানালাম তাও কথাটি
হাজার সালাম চরণে তাঁর
গুরু সিরাজ কাহার
সালাম জানাই তাঁহার
জসিম বিশ্বাস,নসিম বিশ্বাস
তুফান সর্দার
বেলতলার নৈমুদ্দি বিশ্বাস
কত কি বলব আর
আমি নির্গুনে কানাই
সালেম আলেকুম জানাই
ছোট-বড় দশজনের পায়
ঠাকুর তলার এই আসরে
বটবৃক্ষ স্বাক্ষী থেকো
আল্লাহ রসুল ফেলোনাকো
ইদু বিশ্বাসকে ডাক
কথা জিজ্ঞাসী ভাল করে”।
লালন গবেষক অধ্যাপক আবূ তালিব ১৯৫৩ সালের ভাদ্র সংখ্যায় মাহে-নও পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে “ সব লোকে কয়, লালন ফকীর হিন্দু কি যবন,’ গানটির উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, লালন এই গানের শেষ পঙক্তিতে নিজেকে ‘খাতনার জাত’ হিসেবে নিজের পরিচয় উন্মোচন করেছেন। তার গানের শেষ স্তবকটিতে রয়েছে-
বিবিদের নাই মুসলমানী
পৈতা যার নাই সেও বাওনী
বোঝেরে ভাই দিব্যজ্ঞানী
লালন তেমনি খাতনার জাত একখান’।
উক্ত গানটি সম্পর্কে লালন শাহ দরগা কমিটির তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক গোলাম রহমান সাহেব মনে করেন, আলোচ্য গানটিতে লালন নিজেকে মুসলমান সন্তান বলেই প্রকাশ করেছেন। কেননা খাত্না দেওয়ার প্রথা শুধু মুসলমান আর ইহুদীদের মধ্যেই বিশ্বে প্রচলিত।
ফকির লালন শাহ ১৮৯০ সালে ১৭ অক্টোবর ছেউড়িয়াস' আখড়া বাড়িতে দেহান্তরিত হলে তাকে আখড়ার মধ্যে কবরস' করা হয়।
এ সকল তথ্যাদি প্রমান করে লালন শাহ হরিশপুরে মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণকারী একজন মানবতাবাদী মহান কবি ও সাধক।্ এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।
লালন গুরু দরবেশ সিরাজ সাঁইঃ (১৭৫০- ১৮১৯)
ইতিহাস ঐতিহ্যের পাদপীঠ খ্যাত হরিশপুরে অসামান্য সাধক পুরুষ সিরাজ সাঁই ১৭৫০সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হিরাজ তুল্য। পারিবারিক পেশা পাল্কী বাহক (বেহারা সমপ্রদায়) হলেও সিরাজ সাঁই একবারে নিঃস্ব পরিবারের সন্তান ছিলেন না। বেশ কিছু জায়গা জমির মালিক ছিলেন তার পিতা। পিতার মত্যৃুর পর উত্তাধিকার সূত্রে সিরাজ সাঁই সে সম্পত্তির মালিক বনে যান।
সে সময় নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রচলন ছিল না বললেই চলে। কেউ কেউ গ্রামের মক্তবে গমন করে বাল্য কালে কিছুটা আরবী ফার্সি শিক্ষার মধ্যে তাদের বিদ্যা অর্র্জন সীমাবদ্ধ রাখত। সিরাজ সাঁই কিছুদিন মক্তবে যাতায়াতের ফলে সামান্য কিছু আরবী ফার্সির সাথে বাংলা লেখাপড়া আত্মস' করার প্রচেষ্টা চালান। তবে সে লেখাপড়া জমাজমির কাগজপত্র দেখা ও কিতাব পড়তে পারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
বাল্যকাল হতেই পৈত্রিক ব্যবসা পাল্কী বাহনের পেশায় আত্মনিয়োগ করে পিতাকে সহায়তা করার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে যাতাযাত করতে হত সিরাজকে। উনিশ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর পুরা সংসারের দায়িত্বভার সিরাজকে নিজ কাঁধে তলে নিতে বাধ্য হতে হয়। এর এক বছর পর তিনি এক সুশীল, শান্ত, মিষ্টভাষী রমনীকে বিবাহ করেন। পরবর্তী কালে এই মহিলা প্রেমময়ী নারী, স্নেহময়ী জননী, সহানুভুতিশীলা প্রতিবেশীনি রুপে এমন সুনাম অর্জন করেন যা আজও হরিশপুর অঞ্চলে কিংবদন্তী হয়ে আছে।
২৬ বছর বয়সে ছিয়াত্তরের মন্বান্তরের কবলে পড়ে সারা বাংলা জুড়ে দেখা দেয় চরম দুর্ভিক্ষ। খাদ্য সঙ্কটে দেশে কয়েক লক্ষ লোক অকাল মৃত্যু বরন করে। হরিশপুরেও এসময় অসংখ্য মানুষ অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সামাজিক অসি'তরতার কারণে সিরাজের জাত ব্যবসাও এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। পৈত্রিক ভাবে প্রাপ্ত জমিটুকু বিক্রি করে বৃদ্ধ মাতাসহ স্ত্রীকে নিয়ে কোন রকমে জীবন যাপন করতে থাকে। দুর্ভিক্ষ শেষ হতে না হতেই প্রায় সব জমিই শেষ হয়ে যায় সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহের পিছনে। তখন সিরাজের সামনে পাল্কী বাহনের পৈত্রিক পেশাই জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ হিসেবে খোলা থাকে। জীবিকা উপার্জনের জন্য পাল্কী বহন করতে তাকে দেশের বিভিন্ন এলাকাতে গমন করতে হত। এভাবে দেশ ভ্রমনকালে একদিন বিখ্যাত পীর আগর মানিক শাহজীর সাথে পরিচয় হয়। প্রচলিত আছে, একদিন সিরাজ সাঁই’র পালকীতে গমন করে পীর সাহেব এক মুরিদানের বাড়িতে পৌছান। গন্তব্যে পৌছে পীর সাহেব সিরাজকে পারিশ্রমিক দিতে চাইলে সিরাজ পারিশ্রমিক নিতে অস্বীকৃতি জানান। উপরন্ত বলেন, পীরের পায়রবী করতে পারলেই জীবন ধন্য হবে। এঘটনায় পীর সাহেব সিরাজের বিনয় ও ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে আশীষবানী দানে ধন্য করেন। সিরাজ সাঁই তখন পীরের নিকট মুরিদ হওয়ার অকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। এক মুরিদের বাড়িতে বসে আগর মানিক শাহজী সিরাজ সাইকে মুরিদ রুপে গ্রহণ করেন।
মুরিদ হয়ে তিনি পীরের নিকট থেকে এলমে তাসাউফের সবক নেওয়ার পাশপাশি উচু স্তরের অমলের দিকে ঝুকে পড়েন। সুফি মতবাদ ও দরবেশী ভাবধারা এসময় তার অন্তরে গুপ্ত ভান্ডারের মত দানা বেঁধে ওঠে। কিন' প্রকাশ্যে তিনি সিরাজ বেহারা রুপেই পরিচিত হতে থাকেন। নৈমুদ্দীন নামে তার একটি পুত্র সন্তান ছিল। বংশ পরম্পরায় সিরাজ সাঁই বংশধরেরা আজ অবধি হরিশপুর পশ্চিম পাড়ায় দীনহীন পরিবেশে জীবন যাপন করছে।
ইতিহাসেরর পথক্রমায় মহান সাধক ফকির লালন শাহ’র দীক্ষা গুরু হিসেবে পরিচিতি লাভের পর তিনি ইতিহাস খ্যাত হয়ে ওঠেন। এই মহান সাধক ১৮১৯ সালে ইন্তেকাল করেন। নিজ বাড়ির আঙিনায় তাকে সমাহিত করা হয়। বর্তানে দরবেশ সিরাজ সাঁই’র মাজার সংলগ্ন এলাকাতে লালন একাডেমী মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। মাজার চত্বর ও পার্শ্ববর্তী এলাকাতে এখন প্রতি বছর লালন স্মরনোৎসবের আয়োজন করা হয়।
লালন শাহ’র প্রধান ভক্ত সাধক কবি দুদ্দু শাহ (১৮৪১-১৯১৯)
মরমী সাধক ফকির লালন শাহ’র প্রধান ভ্ক্ত হিসেবে দুদ্দু শাহ’র একটি বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। লালন জন্মভূমি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হরিশপুর পূর্ব পাড়া সংলগ্ন ছোট্র একটি গ্রাম বেলতলা। এ গ্রামের অবস'া সম্পন্ন কৃষক ঝড়- মন্ডলের ছেলে দবির উদ্দিন ওরফে দুদ্দু শাহ ১৮৪১ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। ঝড়- মন্ডলের চার ছেলে তারা হলেন- মধু মন্ডল, পিরু মন্ডল, গরাই মন্ডল এবং দবির উদ্দিন ( দুদ্দু শাহ)। চার ভায়ের মধ্যে দুদ্দু শাহ ছিলেন সকলের ছোট। ফকিরি মতে দীক্ষা গ্রহনের পর তিনি দুদ্দু শাহ নাম ধারণ করেন। অবস'া সম্পন্ন গৃহস' পরিবারের সন্তান দুদ্দ শাহ ভাইদের মধ্যে সকলের ছোট হওয়ায় বড় ভায়েরা সংসারের প্রয়োজনে জীবিকা উপার্জনে নিয়োজিত ছিলেন। কিন' তাদের অনুজ প্রতিম দুদ্দুকে সংসারের কোন দায়ভার টানতে দেননি।
বাল্যকালে দুদ্দু হরিশপুরর শ্রীনাথ বিশ্বাসের পাঠশালায় বিদ্যা শিক্ষার সুযোগ অর্জন করেন। তৎকালিন সময়ে এলাকাতে শ্রীনাথ বিশ্বাসের পাঠশালার বিশেষ খ্যাতি ছিল। আশৈশব অসম্ভব মেধাবী দুদ্দু পাঠশালার কোন পাঠ একবার শ্রবণ করলে সঙ্গে সঙ্গে তা আত্মস' করে ফেলতে পারতেন। তার এই প্রখর স্মৃতি শক্তির কারণে শিক্ষকরগন মুগ্ধ হয়ে বালক দুদ্দুকে বিশেষ স্নেহ করতেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি পাঠশালার পাঠ সফল ভাবে সমাপ্ত করেন। শিক্ষা দীক্ষায় অনগ্রসরতা কারণে তৎকালিন সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল কলেজের প্রাচুর্যতা ছিল না। এ কারণে পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করে বাড়িতে স'ানীয় আলেমদের নিকট তিনি আরবী ফার্সি শিক্ষা লাভ করেন। এসময় তিনি নিজ প্রচেষ্টায় সমগ্র কুরআন কণ্ঠস' করে হাফেজ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন বলে প্রচলিত আছে।
সমসাময়িক কালে হরিশপুরে মদন দাস গোস্বামী নামে একজন পন্ডিত ব্যক্তি বাস করতেন। সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত মদন দাস গোস্বামীর নিকট প্রখর মেধাবী দুদ্দু শাহ সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা লাভের মাধ্যমে নিজের নৈপূন্যতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হন। প্রচলিত আছে শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত তার কণ্ঠস' ছিল।
শিক্ষা জীবন শেষে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ভাইদের বদ্যনতায় দুদ্দু সংসারের কায়িক পরিশ্রমের পরিবর্তে জমাজমি তদারকি, খাজনা পত্র আদান প্রদান করে অবশিষ্ট সময় জ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করতেন।
এসময় হরিশপুরে বহু সাধু-সন্যাসী, আউলিয়া দরবেশের বসবাস ছিল। দুদ্দু তাদের কারও কারও সংস্পর্শে এসে সুফিবাদের প্রভাবে ভাববাদী হয়ে ওঠেন। তিনি প্রায়ই হরিশপুস' সাধক দরবেশদের সাথে আধ্যাত্মিক আলাচনায় মত্ত হয়ে সময় অতিবাহিত করতেন। এসময় থেকেই তিনি জীবন পথের সঠিক দিশা অনুসন্ধানের জন্য উপযুক্ত মুরশিদের সন্ধান করতে থাকেন।
ত্রিশ বছর বয়সে তিনি দেশ ভ্রমণে বের হয়ে পড়েন। যশোর, নবদ্বীপ ও নদীয়া জেলার বিভিন্ন স'ান ভ্রমন শেষে তিনি কুস্টিয়া এসে উপনীত হন। উপযুক্ত গুরু সন্ধানের এক মহেন্দ্র ক্ষণে মহামতি ফকির লালনের সাথে তার সাক্ষাত ঘটে। সাধক ও ভাব সঙ্গীতের স্রষ্ট্রা হিসেবে লালনের তখন চারিদিকে ব্যাপক পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে। ছেউড়িয়া আখড়া বাড়িতে বসে দুদ্দু শাহ ফকির লালনের সাথে ধর্মলোচনায় লিপ্ত হন। লালনের অসম্ভব প্রতিভা তাকে মুগ্ধ করে। নিজের অজান্তে হৃদয়ে তিনি লালনকেই গুরুপদে স'ান দান করেন। প্রচলিত আছে লালনের সাথে দুদ্দুর রীতিমত ধর্মীয় বাহাছ হয়। বাহছে লালনের পান্ডত্যের নিকট দুদ্দু পরাজয় বরণ করেন। পরাজয়ের পর তিনি ফকির লালনের হাতে বায়াত হয়ে মুরিদ হওয়ায় অভিলাষ ব্যক্ত করেন। লালন শাহ নিজ হস্তে দুদ্দু শাহকে মুরিদ করে শিষ্যত্ব প্রদানের মাধ্যমে ধন্য করেন। এ বিষয়ে দুদ্দু শাহ তার নিজ জবানীতে উল্লেখ করেন এভাবে-
“বাহাছ করিতে এসে বয়াত হইনু
আমি অতি অভাজন লালন সাই বিনু”।
এরপর থেকে দুদ্দু শাহ নিজ পীরের খেদমতের পাশপাশি জ্ঞান সাধনায় লিপ্ত হয়ে ছেউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে কালকাটাতে থাকেন। দুদ্দু শ্াহ ফকির লালনের একান্তে সান্নিধ্যে অল্প কিছুদিন অতিবাহিত করতে না করতেই নিজের জ্ঞান এবং কর্ম দক্ষতার গুনে গুরুর বিশেষ প্রিয় ভাজন মুরিদ রুপে স্বীকৃত লাভ করেন। এসময় থেকে গুরু প্রতিভার সংস্পর্শে তার সুপ্ত প্রতিভাও পরিপূর্ণ রুপে বিকশিত হয়ে ওঠে। ফকির লালন তার অন্যান্য শিষ্যদেরকে দুদ্দুকে নিজের পিতার সম-মর্যদার আসন দান করে তাদেরকে দাদা বলে ডাকতে নির্দেশ দিতেন। দুদ্দু শাহ গুরু ফকির লালনের মত নিজেও ভাব সঙ্গীত রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন' স্বল্প সময়ের ব্যবধানে লালন অবগত হন-তার প্রিয় মুরিদ ঘোর সংসারী। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর পরই তিনি দুদ্দুকে নিজ পরিবারের নিকট ফিরে যাবার নির্দেশ দান করেন। গুরুর নির্দেশ শিরোঃধার্য মান্য করে তিনি নিজ জ্ন্মস'ান বেলতলা ফিরে এসে পরিবার পরিজনের সাথে সংসার জীবন শুরু করেন।
এসময় হরিশপুরের আর এক সাধক প্রবর পাঞ্জু শাহ’র সাথে দুদ্দু শাহ’র পরিচয় ঘটে। উভয়ের মধ্যে সৃষ্টি হয় হৃদ্রতা পূর্ন সম্পর্ক। বয়সে তিনি পাঞ্জু শাহ অপেক্ষা কিছুটা বড় ছিলেন। ভাবগীতির স্রস্ট্রা এবং চিশতিয়া খান্দানীর ফকির হিসেবে উভয়ের মধ্যে গভীর সদ্ভাব পরিলক্ষিত হয়। দুদ্দু শাহ প্রায়ই পাঞ্জু শাহ’র হরিশপুরস' আঁখড়াতে সময় কাটাতেন। এখানে উভয়ে কুরআন হাদিস ও এলমে মারেফতের তত্ত্ব আলোচনায় মশগুল থাকতেন। দুদ্দু শাহ নিজ গ্রাম বেলতলাতে অবস'ান কালে মাঝে মধ্যে তার গুরু লালন শাহ প্রিয় ভক্তের বাড়িতে আগমন করতেন। এসময় লালন শাহ ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করতেন বলে তৎকালিন সময়ে স'ানীয় প্রবীণ ব্যক্তিগন তথ্য প্রদান করেন।
হরিশপুরের বাসিন্দা প্রবীণ ব্যক্তি মুন্সি আব্দুল আজিজ বরেন-“ বেলতলা দুদ্দু শাহ’র বাড়িতে লালন শাহ’র আগমন ঘটেছে শুনে, আমরা কয়েকজন লালনকে দেখতে গেলাম। সেখানে যেয়ে দেখলাম লালন সভা মধ্যে দণ্ডায়মান। আমার বয়স তখন অল্প হলেও সে স্মৃতি আমার এখনো মনে আছে”।
বৃদ্ধ বয়সে দুদ্দু শাহ খেলাফত (খেরকা) গ্রহণ করেন। ফলে সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব স্বজনদের উপর ন্যস্ত করে তিনি সৃষ্ট্রার সন্তোষ্টি লাভের সাধনা এবং আধ্যাত্মিক ভাব সঙ্গীত রচনায় পরিপূর্ণ রুপে আত্মনিয়োগ করেন। তার রচিত লালন চরিত ও নূরে মোহাম্মদী নামক দুখানি পুঁথি সাহিত্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি অত্যন্ত উচু মানের রচনা শৈলী সমৃদ্ধ সঙ্গীত রচনা করতেন। তার রচিত সঙ্গীতের সংখ্য তিন শাতাধিক বলে জানা যায।
সামপ্রতিক সময়ে দুদ্দু শাহ’র জীবন ও কর্মের উপর গবেষনার ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করছে। তার কর্মময় জীবন ও কাব্য নিযে এক ডজনের বেশি গ্রন' দেশ বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। স্বভাব কবি দুদ্দু শাহ শেষ জীবনে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে পড়েন। অন্ধত্বও তার সঙ্গীত চর্চা বন্ধ করতে পারেনি।
১৯১৯ সালে এই সাধক কবি নিজ বাড়ি বেলতলাতে দেহান্তরিত হন। বাড়ির আঙ্গিনায় তাকে সমাধিস' করা হয়। সমাধি পরিদর্শনের জন্য দেশ বিদেশের গবেষক-পর্যটকগন নিভৃত পল্লী বেলতলায় গমন করে থাকেন।
সাধক কবি পাঞ্জু শাহ( ১৮৫১-১৯১৪)
মরমী সাহিত্য ধারায় ফকির লালন শাহ’র অত্যন্ত প্রিয় ভাজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন কবি পাঞ্জু শাহ। লালন পররবর্তী কবিগনের মধ্যে পাঞ্জু শাহ’র নাম বিশেষ ভাবে স্মরনীয়। লালন শাহ’র আশীষবানী এবং স্বীকৃতি পাঞ্জু শাহকে সাধক সমাজে বিশেষ ভাবে পরিচিত করে তোলে। এ পিরিচিতি তৎকালিন সময়ে তাকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত দেশের সাধক মন্ডলীর পরিচালক রুপে নিয়োজিত থাকার সুযোগ লাভে সহায়তা করে। এ বিষয়ে খোন্দকার রফি উদ্দিনের অভিমত বিশেষভাবে লক্ষনীয়ঃ তিনি বলেন-“বাংলার সুফি ফকিরের মধ্যে লালনের স'ান সর্বোচ্চে। কিন' লালনের তিরোধানের পর যিনি সারা বাংলার ফকির মহলে লালনের শূন্যস'ান পূরণ করে রেখেছিলেন, অসাধারণ প্রতিভাধর লালন শাহের তিরোভাব জনিত শূন্যতা পূরণের ক্ষমতা নিয়ে জন্মে ছিলেন পাঞ্জুু শাহ।” এ কথাটি চিন্তা করলে পাঞ্জু প্রতিভা সম্পর্কে আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ থাকে না। বস'ত পাঞ্জু শাহ যথার্থ পূর্বসূরির মর্যদা উপলদ্ধি করতে পেরে ছিলেন। সে জন্য তিনিও লালনের ভাবশিষ্য হয়েই কাব্য চর্চায় আত্ম নিয়োগ করেন। ফলে সমকালিন বাংলাদেশে পাঞ্জুর কবি খ্যাতি ও মরমী ভাব সাধনা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তাই দেখা যায় ফকির লালনের অত্যন্ত বয়ঃকনিষ্ঠ সমসাময়িক এই সাধক একটি স্বতন্ত্র ঘরনা ও বিশেষ কাব্য সঙ্গীত গোষ্ঠির উদ্যোক্তা হিসেবে উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে এদেশের সাহিত্য সাংস্কতিক অঙ্গনে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ক্ষেত্র বিরাজমান। এসব দিক পর্যালোচনা করলে পাঞ্জু শাহ’র জীবন ইতিহাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
কবি পাঞ্জু শাহ ১২৫৮ বঙ্গাব্দে (১৮৫১ খ্রিঃ) ২৮শে শ্রাবণ ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। এসময় কবি পিতা খোন্দকার খাদেম আলী এবং মাতা জোহরা বেগম শৈলকূপাস' নিজেদের জমিদার ভবনে বসবাস করতেন। খোন্দকার খাদেম আলী ছিলেন পাঁচ সন্তানের জনক। তার সন্তনগন হলেন যথাক্রমে শাহারণ নেছা, তহিরণ নেছা, খোন্দকার পাঞ্জু, খোন্দকার ওয়াসিম উদ্দিন ও আইমানী নেছা। পাঞ্জু শাহ পিতামাতার তৃতীয় সন্তান ছিলেন।
খোন্দকার খাদেম আলী যখন শৈলকূপা ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী উপজেলার হরিশপুর অভিমুখে যাত্রা করেন তখন তার জ্যেষ্ঠ কন্য শ্বশুরালয়ে, মেজে কন্যা পরলোকে এবং কনিষ্ঠ কন্যার জন্ম হয়নি। সুতারং ভাগ্য বিড়ম্বিত এই অমানিশায় বালক পাঞ্জু এবং শিশু ওয়াসিম পিতার সহযাত্রী হিসেবে হরিশপুর গমন করেন। হরিশপুর আগমনের পর কনিষ্ঠ কন্যা আয়মানীর জন্ম হয়।
পাঞ্জু শাহ’র জীবন প্রকৃত পক্ষে হরিশপুর থেকেই শুরু।“ বসতি মোকাম মেরা হরিশপুর গ্রাম” একথা কবি তার নিজ লেখনীতে উপস'াপন করেন। বস'ত বিলাসী জমিদার নন্দন রুপে নন, কঠোর সংগ্রামী মোল্লার সন্তান রুপেই তিনি বেড়ে উঠতে থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোন বিদ্যালয়ে তার লেখা পড়ার সুযোগ হয়নি। বাড়িতে উস্তাদের নিকট আরবী ফার্সী শিক্ষার মধ্য দিয়েই তার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়।
পাঞ্জু শাহ’র পিতা একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন্। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি ছিল তার অসম্ভব শ্রদ্ধাবোধ। খোন্দকার রফি উদ্দীন বলেন-ফকির পাঞ্জু শাহ’র পিতা একজন গোঁড়া মুসলমান ছিলেন। শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়ায় তিনি সন্তানকে বাংলা ভায়ায় শিক্ষা দানের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। পিতার অনাগ্রহের কারনে বালক পাঞ্জু ছোট বেলায় আরবী ফার্সী ছাড়া বাংলা ইংরেজি শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। কিন' বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তিনি উপলদ্ধি করেন যে, মাতৃভাষা ভালভাবে আয়ত্ত্ব করতে না পারলে আত্ম চিন্তা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। ফলে তিনি ষোল বছর বয়সে হরিশপুর নিবাসী মহর আলী বিশ্বাসের নিকট বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ শুরু করে সফলতা লাভ করেন।
এখানেই পাঞ্জুর অনিয়মিত ছাত্র জীবনের সমাপ্তি ঘটে। বৃদ্ধ পিতাকে সাহায্য করার তাগিদে বেশ খানিকটা সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে চেপে বসে। এভাবে সংসার জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। চব্বিশ বছর বয়সে পাঞ্জু চুয়াডাঙ্গা জেলার আইলহাস- লক্ষীপুর গ্রামের খোন্দকার আব্দুর রহমানের কন্যা ছন্দন নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই পূন্যবতী-গুনবতী জীবন সঙ্গীনি পাঞ্জু শাহ’র সাধক জীবনকে বিভিন্ন ভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। বিবাহের দুই বছর পর তাদের প্রথম সন্তান শামস্ উদ্দিন জন্ম গ্রহণ করে। পরবর্তী কয়েক বছরের ব্যবধানে কলিমন নেছা ও ছালেহা খাতুন নামে দুই কন্যা সন্তান জন্ম লাভ করে।
সাতাশ বছর বয়সে পাঞ্জু শাহ’র পিতৃ বিযোগ ঘটে। সঙ্গত কারনেই তখন সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়। কর্তব্য পরায়ন পাঞ্জু এ গুরুভার বহনে কখনো পিছপা হননি। পরিবারের সকলের সুবিধা অসুবিধার প্রতি তিনি তীক্ষ্ম নজর রাখতেন। এসময় পৈত্রিক বসত ভিটা কনিষ্ঠ ভ্রাতা খোন্দকার ওয়াসিম উদ্দিনকে ছেড়ে দিয়ে সাত বিঘা জমি খরিদ করে সেখানে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেন। এছাড়া আরো পঁচিশ বিঘা মাঠান জমি ক্রয় করে সংসারে সচ্ছলতা আনায়নে বিশেষ ভূমিকার রাখেন। কৈশর থেকেই পাঞ্জু শাহ মরমীবাদের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। কিন' পিতার অনাগ্রহের কারণে তার জীবিত অবস'ায় পা্রকাশ্য ভাবে কোন ফকিরি মজলিসে তিনি যেতে পারতেন না। পিতার পরলোক গমনের পর তিনি ফকিরি মজলিসে অবাধে যাতায়াত শুরু করেন্ ।
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে পাঞ্জু শাহ খেরকা গ্রহনের মাধ্যমে পুরাপুরি ফকিরি মতবাদে দীক্ষিত হন। এসময় থেকেই তার সাধক জীবনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। একটি আধ্যাত্ম চেতনা লাভ করে তিনি সাধনার উচ্চমার্গে আরোহন করেন। খোন্দকার হিরাজ তুল্লাহ নামে জনৈক তত্ত্ব সাধকের নিকট তিনি দীক্ষা গ্রহণ করেন।
পাঞ্জু শাহ ধুয়োজারি, ভাব সঙ্গীত এবং হিন্দু মুসলমানদের আধ্যত্ম সাধনা দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি সাধক হিরাজতুল্লার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সুফি ভাবধারায় গান রচনা শুরু করেন। তার রচিত মরমী গানের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। গানগুলি বাউল তত্ব দ্বারা প্রভাবিত। এসকল গান তার শিষ্যগন মুখে মুখে গেয়ে সমাজে প্রচার করতেন। তার পুত্র খোন্দকার রফি উদ্দীন রচিত ভাব সঙ্গীত গ্রনে' বেশ কিছু গান সঙ্কলন করেন। এছাড়া ড. খোন্দকার রিয়াজূল হকের মরমী কবি পাঞ্জু শাহ; জীবন ও কাব্য গ্রনে' তার রচিত দুই শতাধিক গান প্রকাশ করেন।
পাঞ্জু শাহ তার কবিতা ও গানে মানবতার জয়গান করেছেন। একটি গানে তিনি বলেন- ‘মানুষের করণ মানুষ ভিন্ন নয় ওরে মন’। ১৮৯০ সালে ছহি ইস্কি ছাদেকী গহোর নামে তার একখানা কাব্য গ্রন' প্রকাশিত হয়। এখানে সুফি তত্ত্বের মর্মকথা ও নৈতিক উপদেশ বর্ণিত হয়েছে।
সমাজ জীবনেও পাঞ্জু শাহ অত্যন্ত অমায়িক ও জনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সমাজের গুনি ব্যক্তিদের তিনি যথেষ্ট কদর করতেন। গুনিদের সাথে তিনি দরবারে বসতেন এবং সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের পরামর্শ চাইতেন। অতিথি পরায়নতা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। কোন আবেদনকারী সায়েলকে তিনি শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। এতিম, বিধবা, অসহায় দুস'্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সর্বদাই তার অনুকম্পা পেয়ে থাকতেন।
আখঁড়া তত্ত্বাবধানের জন্য এসময় আরো একজন জীবন সঙ্গীনীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কুস্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার বড়-লিয়া নিবাসী অফিল উদ্দিনের কন্যা পাচি নেছাকে ২য় স্ত্রী হিসেবে বিবাহ করেন। উভয় স্ত্রীর মাঝে তিনি বৈষম্যহীন অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এক অনন্য নজীর স'াপন করেন। তিনি প্রথম স্ত্রীকে আদর করে রজনী এবং ২য় স্ত্রীকে প্রেয়সী বলে সম্বধন করতেন।
পাচি নেছার গর্ভে তিন পুত্র এবং এক কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। তারা হলোঃ খোন্দকার শফি উদ্দিন জয়তুন নেছা, খোন্দকার রফি উদ্দিন এবং খোন্দকার রইছ উদ্দিন। ব্যক্তি জীবনে পাঞ্জু শাহ ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিদে বিলাসহীন মানুষ। সাধারন ডাল ভাত খেযেই তিনি দিনপাত করতেন। তিনি নিজে মাছ মাংস না খেলেও শিষ্যদের মাছ মাংস বর্জনের বিষয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি।
১৯১৪ সালে তিনি হরিশপুর আখড়াতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পূর্ব পশ্চিম মুখি করে তাকে নিজ গৃহে সমাধিস'' করা হয়। দুই পাশে তার দুই স্ত্রীকে সমাহিত করা হয়। এখানে বছরে একাধিক সময়ে স্মরনোৎস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ সকল অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তবৃন্দ উপসি'ত হয়ে থাকে।
জনকল্যানের মূর্ত প্রতীক ফকির মাহমুদ বিশ্বাসঃ( ১৮১৬-১৮৯৩)
ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু থানার অন্তর্গত রঘুনাথপুর ইউনিয়নের কালাপাহাড়িয়া গ্রামে ১৮১৬ সালে ফকির মাহমুদ বিশ্বাস জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা আদম আলী বিশ্বাস ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। পিতার দরিদ্রতার কারণে দুঃখ কষ্টে কাটে ফকির মাহমুদের শৈশব কাল। বৈবাহিক সূত্রে ফকির মাহমুদ একজন অবস'া সম্পন্নন কৃষকে পরিণত হন। অনেক জমাজমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি অতি সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করতেন। কায়িক পরিশ্রম প্রিয়তা ছিল তার জীবনের ভূষণ। মাঠে মাঠে অবলীলায় গরু ছাগল চরিয়ে বেড়াতে দ্বিধাবোধ করতেন না। সুফি সাধনার ফলে তার হৃদয়ে উন্নত মানসিকতার বিকাশ ঘটে। তিনি একজন খাটি নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন্
বাল্যকাল অতি কষ্টের মধ্যে অতিবাহিত হলেও সচেতন কৃষক পিতার আন্তরিকতায় ফকির মাহমুদ মক্তবে গমন করে ফার্সি ভাষায অনেকখানি জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। বাল্যকালের এ শিক্ষাাই তার পরিণত বয়সের ধর্মীয় সদাচারন রপ্তে বহুলাংশে সহায়ক হয়ে ওঠে। জন্মস'ান কালাপাহাড়িয়া গ্রামের পশ্চিম পাশে
নটাবিল নামক একটি প্রসিদ্ধ বিল আছে। কিশোর বয়সে তিনি এ বিলের ধারেই অধিকাংশ সময় গরু
ছাগল চরানোর পাশাপাশি পিতাকে কৃষি কাজে সহায়তা করতেন। তৎকালে নটাবিল হতে জলস্রোত দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে হরিণাকুণ্ডুর কুমোর রাজা খ্যাত রাজা হরিষচন্দ্র পাল কর্তৃক খননকৃত কুমরাইল নামক নদীতে পতিত হত। এমন পরিবেশে সাধারণ রাখাল বেশে নিজ গ্রামে তার বাল্যকাল কাটে।
কুলবাড়িয়া গ্রামের দক্ষিণ পার্শ্বস' বলরামপুর গ্রামের জোর্য়াদার পরিবার একটি সুপরিচিত গোষ্ঠি। এ পরিবারে ভাদু জোয়ার্দার ও সাদু জোয়ার্দার নামে দুই অবস'া সম্পন্ন কৃষক ভ্রাতা বসবাস করতেন। তাদের তিন হাজার বিঘার অধিক সম্পত্তি ছিল বলে জানা যায়। ভাদু জোয়ার্দারের একমাত্র বিদূষী কন্যাকে সম্ভ্রান্ত পরিবারে উপযুক্ত পাত্রের সাথে বিবাহ দেওয়ার জন্য মনসি'র করেন। কিন' কোথাও তেমন উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান মিলাতে পারেন না পিতা।্ অবশেষে পাশের গ্রামের তরুন ফকির মাহমুদের উপর ্কন্যা পক্ষের নজর পড়ে। ভাদু জোয়ার্দারের একমাত্র কন্যার সাথে এক শুভক্ষনে ফকির মাহমুদ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহ সূত্রে তিনি বিপুল সম্পত্তির মালিক হন। বিবাহের পর শ্বশুরের অনুরোধে বেশ কয়েক বছর তিনি পিতামাতাসহ শ্বশুরালয়ে বসবাস করতে থাকেন। তার দুই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শ্বশুর বাড়ির পার্শ্ববর্তী কুলবাড়িয়া গ্রামের উত্তরাংশে নিজেদের জমিতে বাড়ি নির্মান করে স'ায়ী ভাবে বসবাস শুূরু করেন। বর্তমানে তার বাড়িটিতে মাজার, মসজিদ ও এতিমখানা অবসি'ত। তিনি ছিলেন অতিথি পরায়ন ও দানশীল ব্যক্তি। সব শ্রেণি পেশার মানুষের বিপদে অপদে তিনি নিদানের ঢাল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিজ বাড়িতে ফলের বাগান ও পুকুর খনন করে জনসেবা করতে থাকেন। এছাড়া কুলবাড়িয়া গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে ৭/৮ বিঘা জমিতে আর একটি বিশাল বাগান তৈরী করেন। যেখানে এখন কুলবাড়িয়া কেন্দ্রীয় ঈদগাহ এবং মসজিদ অবসি'ত। ঐতিহাসিক ঈদগাহটির দৈর্ঘ্য-৩৯ ফুট, প্রস' সোয়া ৩ ফুট এবং উচ্চতা ৩৭ ফুট। এরূপ ঈদগাহ দেশের ইতিহাসে বিরল। প্রাচীন কালে কুলবাড়িয়াসহ পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামের লোকেরা এখানে ঈদের নামাজ আদায় করত।
এছাড়া নিজ হাতে কৃষিকাজ করে প্রচুর ফসল ফলাতেন। কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি আজীবন মানব সেবা করে গেছেন। তার জীবনীতে অনেক অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে।
একবার বারজন মহিষ গাড়োয়ান দক্ষিণ দেশে ধান তুলতে যাচ্ছিলেন। কুলবেড়ে মাঠে পৌছে তারা লক লকে মটর ক্ষেতে মহিষ লাগিয়ে দেয়। এসময় একজন গাড়োয়ান আফসোস করে বলে-“আহারে! কত ভাল শাক, রুই মাছ দিয়ে এ শাক রান্না করে ভাত খেতে পারলে হত”। ফকির মাহমুদ উচু ক্ষেতের অপর প্রান্তে বসে গাড়োয়ানের সব কথা শুনতে পান। লোকজনের মাধ্যমে গাড়োয়ানদের নিজ বাড়িতে ডেকে এনে, পুকুর থেকে রুই মাছ এবং ক্ষেত থেকে মটর শাক তুলে রান্না করে তাদের খেতে দেন। পরের ক্ষেত পশু দিয়ে খাওয়ানো চরম অন্যায়, একথা তাদের বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বলেন। লজ্জিত গাড়োয়ানগন নিজেদের অপরাধের জন্য বার বার ক্ষমা প্রার্থণা করে বিদায় নেন।
ফকির মাহমুদ বিশ্বাসের দানশীলতার আরো একটি বিশেষ ঘটনা লোকে মুখে এখনও প্রচারিত। কুলবাড়িযা গ্রামে দক্ষিণ পূর্ব দিকে বলরামপুর মৌজায় তার একটি বিশাল বাগান ছিল। এই বাগানে প্রতিবছর চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাসে তিনি জলছত্র বসাতেন। দুপুর বেলা পথিকদেরকে তিনি ভিজানো ছোলা ও আখের গুড় সহযোগে পানি পান করাতেন। এটি তিনি আমৃত্যু জারি রেখে ছিলেন। এখন এটি বিশ্বাসের বাগান নামে পরিচিত। এ রকম অনেক ঘটনায় ভরপুর ছিল এই মহান সাধক ব্যক্তির জীবন।
ফকির মাহমুদ বিশ্বাসের চারপুত্র সন্তাণ ছিল। তার কোন ওয়ারিশ বর্তমানে কুলবাড়িয়াতে বসবাস না করলেও পার্শ্ববতী শীতলীসহ অন্যান্য স'ানে বসবাস করেন বলে জানা যায়।
এই মহান সাধক কোনদিন পোষাকী দরবেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেননি। দরবেশী জীবন আড়াল করে সাধারণ মানুষের মত জীবন অতিবাহিত করে ১৮৯৩ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। নিজ বাড়ির আঙিনায় তাকে সমাহিত করা হয়।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক বিপ্লবী বাঘা যতীনঃ (১৮৮০-১৯১৫)
বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে যশোর একটি ঐতিহাসিক স'ান লাভ করে আছে। এদেশের বিপ্ল্লবীদের ইতিহাসে বৃহত্তর যশোরের ঝিনাইদহ মহকুমার হরিণাকুন্ডু থানার বিপ্লবী বাঘা যতীনের নাম বিশেষ ভাবে স্মরনীয়। বাঘা যতীনের পূর্ন নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। পিতা উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতা শরৎ শশী দেবী দম্পতির কোল জুড়ে বিপ্লবী বাঘা যতীন ১৮৮০ সালের ৭ ডিসেম্বর হরিণাকুন্ডু থানার রিশখালি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
শৈশবের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় এখানে অতিবাহিত হয়। বড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নবগঙ্গা নদীতে দুরন্ত সাহসিকতার সাথে সাঁতার কাটায় তিনি শৈশবেই বেশ পারদশী হয়ে উঠেন। খেলাধুলায় সাথীদের সাথে তিনি নিয়মিত শরীর চর্চা করতেন। শারীরিক শক্তির জন্য তিনি বিশেষ ভাবে খ্যাতিমান ছিলেন। কৈশরের পথ পাড়ি দিতে না দিতেই তার পিতৃবিয়োগ ঘটে। তারপর বিধবা মা শরৎ শশী দেবী কন্যা বিনোদ বালা ও পুত্র যতীনকে সঙ্গে তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালি থানার কয়া গ্রামে পিত্রালয়ে চলে যান। যতীন্দ্রনাথের মা শরৎ শশীদেবী ছিলেন স্বভাব কবি।
যতীনের প্রাথমিক শিক্ষা হাতে খড়ি শুরু হয় মাতুলালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি কৃষ্ণনগরে বড় মামা বসন্ত কুমার চট্রোাপাধ্যয়ের বাসায় থেকে পরবর্তী শিক্ষা জীবন অব্যাহত রাখেন। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগর এ.ডি হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রাস পাশ করেন। পরে যতীন চলে এলেন মেজো মামা ডা. হেমন্ত কুমার চট্রোপাধ্যয়ের কলকাতার বাসায়। এখানকার সেন্ট্রাল কলেজে এফ.এ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও ডিগ্রি অর্জন করা আর সম্ভব হয়নি। এসময় তিনি সর্টহ্যান্ড-টাইপ রাইটিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পড়াশোনার ইতি টেনে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন। প্রথমে স্টেনোগ্রা্রফার হিসেবে আমন টি কোম্পানিতে, পরে মুজাফফরপুরে ব্যারিষ্টার ও ত্রিহুত কুরিয়ার পত্রিকার সম্পাদক মিঃ কেনেডির অধীনে চাকরী করেন। কিন' এখানে তার মন না টিকায় কিছু দিনের ব্যবধানে পূনরায় তিনি কলকাতায় ফিরে এসে ইন্দুবালা নামে এক রমনীর সাথে পরিনয় সূত্রে আব্ধ হন।
১৯০৩্ সালে তিনি বাংলা সরকারের চীফ সেক্রেটারী মি.হুইলারের স্টেনোগ্রাফার হিসেবে সরকারি চাকুরীতে যোগদান করেন। ছোট লাটের খাস সচিবের অফিসে চাকুরি হবার কারনে কর্মপোলক্ষে তাকে শীত ও বর্ষাকালে কলকাতায় এবং বসন্ত ও গ্রীষ্মে দার্জলিং থাকতে হতো। এসময় তিনি বিপ্ল্লবীদের সাথে পরিচিত হয়ে তাদের পরিচালিত আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন। এভাবেই তিনি খোদ বৃটিশ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ছাত্র অবস'ায় তিনি উপলদ্ধি করেন, ছোট মামা ব্যারিষ্টার নিমাই চট্টোপাধ্যায় নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর ’আজাদহিন্দ’ ফৌজের সদস্য ছিলেন। তখন থেকেই দেশপ্রেমিক ্ও স্বাধীনচেতা যতীন বিপ্লবীদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি কর্ম জীবনে বিপ্লবী ঋষি অরবিন্দ, যতীন ব্যার্নাজী, রাসবিহারী বসু প্রমুখের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে ইংরেজ সরকার তাকে গ্রেফতার করে। বিচারে তার এক বছরের সাজা প্রদান করা হয়। সেই সাথে চাকুরী থেকে বরখস্ত করা হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ঝিনাইদহে ফিরে এসে ঠিকাদারী ব্যবসা শুরু করেন। এসময় তিনি বর্তমান ঝিনাইদহ কেসি কলেজের উত্তর পাশের একটি বাড়িতে বসবাস করতেন। এখান থেকেই তিনি যশোর, নদীয়া ও ফরিদপুরের বিভিন্ন স'াপনার ঠিকাদার হিসেবে কাজ পরিচালনা করতেন। তার ঠিকাদারিত্বেই যশোর কালেক্টারেট ভবন এবং ঝিনাইদহ ক্যাসেল ব্রীজ এর মত ঐতিহাসিক স'াপনা নির্মান করা হয়। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে প্রায়ই তাকে যশোর, নদীয়া এবং ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতে হতো। এ সুযোগে তিনি সংগোপনে ইংরেজ বিরোধী একটি বিপ্লবী দল গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। ঝিনাইদহের কালিগঞ্জের নলডাঙ্গার পাশে বলরামপুরে বিপ্ল্ল্লবের কেন্দ্র স'াপন করা হয়। তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে বিপ্ল্লবীদের সংগঠিত করে নিজ দলের তৎপরতা জোরদার করতে থাকেন। বহু তরুণ-যুবক দেশ প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে তার আদর্শের সাথে একাত্মতা প্রকাশের মাধ্যমে দলে যোগদান করে কৃতিত্বের সাথে বৃটিশ বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। নিকুঞ্জবিহারী প্রনীত ’বাংলার সেরা বিপ্ল্লবী’ গ্রনে' স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যতীনদ্রনাথ মুখোপাধ্যাযের মাতুল পরিবারের গভীর ঘনিষ্ঠতার কথা উল্লেখ আছে। যতীনের যোগাযোগ ছিল বিপ্ল্ল্লবের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ বর্তমানে খুলনার বি.এল কলেজের সাথেও।
যতীন্দ্রনাথের নাম বাঘা যতীন হওয়ার পিছনে রয়েছে একটি দুর্দান্ত কাহিনী । কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামে মামার বাড়িতে থাকাকালিন সময়ে ঐ অঞ্চলে বাঘের উৎপাত বেড়ে য়ায়। একদিন গ্রাম সংলগ্ন জঙ্গলে একটি বাঘ আসার খবর রটে যায়। এ খবর পেয়ে যতীন্দ্রনাথ সেখানে উপসি'ত হয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে বাঘের সঙ্গে একাই কুস্তি লড়ায় চালাতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে বাঘকে পরাস্ত করে ভোজালী দিয়ে বাঘটিকে হত্যা করতে সক্ষম হন। আর তখন থেকেই চারিদিকে তিনি বাঘা যতীন নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। বাঘের নির্মম কামড়ে তার দুটি পা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। কলকাতায় এসে তাকে দীর্ঘদিন ধরে এর চিকিৎসা নিতে হয়েছিল।
এই বাঘা যতীনই স্বদেশ থেকে বেনীয়া ইংরেজ খেদাও আন্দোলনেসর কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই বাংলা থেকে উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত বিস-ৃত ভূখন্ডের ইতঃস্তত বিচ্ছিন্ন সংগঠনগুলো একই কর্মকান্ডের অধীনে আসে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মান সরকারের কয়েক জাহাজ অস্ত্র উপমহাদেশের বিপ্লবীদের জন্য সংগৃহিত হয়। এ অস্ত্রের চালান হস্তগত করার জন্য উড়িষ্যার বালেশ্বর শহর থেকে কুড়ি মাইল দুরবর্তী ময়ুরভঞ্জের জঙ্গলে অবসি'ত নীলভেরী পাহাড় সংলগ্ন দূর্গম এলাকায় কাপ্তিপোদা নামক স'ানে চারজন বিপ্লবী যোদ্ধাসহ অবস'ান গ্রহণ করেন। এরপর মহলদিয়া গ্রামের এক কুঁড়ে ঘরে সাধুবাবা ও চার শিষ্য পরিচয় দিয়ে বসবাস করতে থাকেন। কিছুদিন পর তালদিহা গ্রামে আস্তানা গাড়েন। কিন' অস্ত্রের চালানের খবর ইংরেজ সরকার অবগত হয়ে পড়ায় পথি মধ্যে জাহাজের অস্ত্র ধরা পড়ে যায়। অস্ত্র ধরা পড়ার পর থেকে ইংরেজ পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। এসময় তিনি বালেশ্বর বুড়িবালাম নদীর তীরে একটি পরিখা খনন করে সেখানে সঙ্গীসহ অবস'ান গ্রহণ করেন। যথা সময়ে খবর পৌছে গেলো বৃটিশ পুলিশের কাছে। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৯ সেপ্টম্বর বাঘা যতীনসহ মাত্র ৫জন বিপ্ল্লবীকে দমন করতে রাদার ফেের্েডর নেতৃত্বে শত শত পুলিশ এসে ঘেরাও করে ফেললো পরিখা এলাকা। অনেকক্ষন ধরে চলে গুলি বিনিময়। গুলিতে দেশপ্রেিমক চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী ঘটনা স'লেই নির্মম ভাবে নিহত হন। তারপর হঠাৎ পরপর দুটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় বাঘা যতীনের শরীরে। একটি তলপেটে অন্যটি বাম হাতে। তিনি গুরুতর ভাবে আহত হন। ইংরেজ পুলিশ তাকেসহ গুরুতর আহত অবস'ায় অপর তিন সহযোদ্ধাকে বন্দী করে বালেশ্বর হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরের দিন ভোর বেলায় এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার লাশ কোথায় কি করা হলো, অদ্যাবিধি তার কোন হদিস পাওয়া সম্ভব হয়নি। মানুষের মুখে অমর হয়ে রইলেন স্বদেশী আন্দোলনের মহান সৈনিক বিপ্ল্লবী বাঘা যতীনসহ তার অসম সাহসী চার বিপ্ল্ল্লবী সাথী। কবির কলমে তা ফুটে উঠলো এভাবে-
“বৃটিশের সাথে যুদ্ধ করেছে
তোমার পঞ্চ বীর।
বুকের রক্তে রাঙায়ে দিয়েছো
বুড়ি বালামের তীর”।
ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু থানার রিশখালী গ্রামের কৃতি সন্তান এই দেশ প্রেমিক বিপ্লবী নেতা স্বাধীন ভারতের সুর্যোদয় না দেখেই ১০ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান। দেশের জন্য জীবন উৎস্বর্গকারী এই মহান বীর মৃত্যুকালে স্ত্রী ইন্দুবালা, কন্যা আশালতা এবং পুত্র তেজেন্দ্রনাথকে রেখে যান। বালেশ্বর হাসপাতালের অদুরে ’চাষাখ-” নামক স'ানে বাঘা যতীনের স্মরনে একটি ম্মৃতি সৌধ নির্মিত হয়েছ্ে। নিজ জ্ন্মভূমি ঝিনাইদহ শহরে এবং মাদ্রাজে বাঘা যতীন নামে সড়কের নাম করন করা হয়েছ্্ে। কলকাতায় বাঘা যতীনের নামে একটি রেল স্টেশনে আছে। কিন' তার পৈত্রিক ভিটা হরিণাকুন্ডু থানার রিশখালি গ্রামে নেই তার নামে কোন ম্মৃতি চিহ্ন। বাঘা যতীনের মুল বসত ভিটা অবহেলিত উপেক্ষিত থাকতে থাকেতে এখন বেদখলে। ভিটার অদুরে ২০১৩ সালে সরকারী অনুদানে বাঘা যতীন ক্লাব নামে একটি সংস'ার ভিত্তি প্রস্তর স'াপন করা হয়েছে। বিশ্ববরন্য এই বিপ্লবী বীরের বসত ভিটা উদ্ধার করে তা যথাযথ ভাবে সংরক্ষনের পাশপাশি বায়া যতীন স্মরনে জনকল্যান মূলক প্রতিষ্ঠান নির্মানের উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
আনোয়ার আলী মিঞা-শিক্ষার এক আলোকবর্তিকা (১৯১৫-১৯৯৮)
আনোয়ার আলী মিঞা ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর হুরিণাকুণ্ডু উপজেলার বেলতলা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ওয়াজির আলী বিশ্বাস বৃটিশ ভারত সরকারের অধীনে রেলওয়েতে চাকুরী করতেন। চাকুরীর শেষ জীবনে ষ্টেশন ম্যানেজার থাকা অবস'ায় অবসর গ্রহণ করেন। ঐ সময় তিনি এন্ট্রাশ পাশ করে চাকুরীতে যোগদান করেন। ওয়াজির আলী বিশ্বাস পারবতীপুরের বনেদী জোয়ারদার পরিবারে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আনোয়ার মিঞার স্ত্রী জোহরা খাতুন তার পিতার প্রথম কন্যা সন্তান ছিলেন।
আনোয়ার মিঞা শিক্ষা লাভ করেছিলেন তৎকালীন নিলফামারী জেলার চিলাহাটী রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকটে জলপাইগুড়ির রাজার প্রতিষ্ঠিত গাতলী সকুলে। পরে তিনি ১৯৩১ সালে সৈয়দপুরে রেলওয়ে হাই সকুল থেকে ম্যাট্রিক ( এসএসসি) প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯৩৪ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই.এ (এইচএসসি) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্ত্বের সাথে পাশ করেন। অতঃপর কলিকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ১৯৩৭ সনে বি.এ. পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। পড়াশুনা শেষ করে তিনি তৎকালীন বৃটিশ ভারত রেলওয়েতে কলিকাতায় যোগদান করেন। কিছুদিন চাকুরীর পর তিনি সৈয়দপুর রেলওয়ে ষ্টেশনে পোষ্টিং পান এবং পরে আবার কলিকাতায় বদলী হন। তিনি ১৯৩৭ সালের ১০ইং জুন কুষ্টিয়া জেলায় জগতি রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকট চৌড়হাস গ্রামে খাঁন বাহদুর আজিজুর রহমানের প্রথম কন্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬২ সালের ৯ই মে প্রথম স্ত্রীর বিয়োগের পর তিনি পরের বৎসর পুনঃ বিবাহ করেন। তিনি ৮ ছেলে এবং ৪ মেয়ের জনক ছিলেন। ছেলে মেয়েরা সকলেই নিজ নিজ পেশায় সফল ব্যক্তিত্ব।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কলকাতায় জাপানী বোমা হামলার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় আনোয়ার আলী তার মায়ের অনুরোধে রেলওয়ের চাকুরীতে ইস্তফা দেন। কেননা তিনিই ছিলেন তার মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান। তার পিতাও তখন জীবিত ছিলেন না। তিনি চাকুরী ছেড়ে ১৯৪৩ সালে নিজ গ্রাম বেলতলায় ফিরে আসেন। একই সালে তিনি ঐতিহ্যবাহী জোড়াদহ হাই সকুলে শিক্ষক পদে যোগদান করেন। এখানে তিন বৎসর চাকুরী করার পর তিনি হরিনাকুন্ডু হাই স্কুলে (পাইলট সকুলে) যোগদান করেন। ২ বৎসর চাকুরী করার পর তিনি ১৯৪৮ সালে পুনরায় জোড়াদহ হাই সকুলে ফিরে যান। জোড়দাহ হাই সকুলে পঞ্চাশ দশকের শেষ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। পরে তিনি ১৯৫৯ সালে আবার হরিণাকুণ্ডু হাই স্কুলে যোগদান করে সেখান থেকে আশির দশকে অবসর গ্রহণ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন সৎ, নিরাহংকার, সরলমনা, নির্ভীক, দৃঢ়চেতা ও দুরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন। তার সন্তানদের গ্রাম থেকে ঢাকার খ্যাতিমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে সু-শিক্ষার ব্যবসহা গ্রহণ করেন। যার ফলে তার প্রতিটি সন্তানই জীবনে সফলতার মুখ দেখেন। তিনি শিক্ষা এবং শিক্ষকতাকে জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অসংখ্য কৃর্তি শিক্ষার্থী গড়তে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। হরিনাকুন্ড থানা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও অনেক শিক্ষার্থীর কৃতি জীবন প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল অগ্রগন্য। একারনে এলাকায় অনেক প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে শহরে সরকারী বা আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকুরীতে প্রবেশ করে বিলাসী জীবন যাপন করতে পারতেন। তার আত্মীয় স্বজনগন যে অবস'ানে ছিলেন, সে কারনে তাৰ ভাল মানের কর্মসংস'ানের সমস্যাই ছিল না। কিন' তিনি নিভৃত পল্লী গ্রামে তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ ত্যাগ করে শিক্ষার আলোকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার মহান আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন। পঞ্চশ দশক অথবা পরবর্তী সময়ের অত্র এলাকায় যাতায়াত সমস্যা, আর্থ-সামাজিক অবসহা এবং সর্বোপরি শিক্ষা গ্রহনের কথা চিন্তাও করতে পারেনি সাধারন জনগন। তখন এসব এলাকার নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জোড়াদহ, হরিণাকুন্ডু, ফুলোহরী স্কুল বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কাঁচা রাস্তা দিয়ে বর্ষাকালে যাতায়াত করতে অসম্ভব কষ্ট শিকার করতে হত। হাঁটা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। তিনিসহ অন্যান্য শিক্ষকরা পায়ে হেঁটে কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সকুলে যাতায়াত করতেন। শিক্ষাকে জীবনের ব্রত হিসাবে না নিলে কারোও পক্ষে এ ধরণের কষ্ট শিকার করা সম্ভব নয়। সন্তানদের সাইকেল কিনে দেওয়ার প্রস্তাবকে কখনোই মেনে নেননি তিনি। তিনি বলতেন, প্রতিদিন হাঁটলে শরীর ভাল থাকে, সুসহ্য থাকে। তাই বেলতলা থেকে হরিণাকুন্ড পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ কিলোমিটার পথ ঝড় বৃষ্টি, রোদ উপেক্ষা করে পায়ে হেঁটে সকুলে যেতেন। তখন এলাকার বাইরে যেতে হলে অর্থাৎ ঝিনাইদহ যেতে হলে এই দীর্ঘ পথ হেঁটে / গরুর গাড়ী / ঘোড়ার গাড়ী / মহিষের গাড়ী অথবা সাইকেলে যেতে হতো। আলমডাঙ্গা রেলষ্টেশন বেলতলা থেকে ২০ কিলোমিটার পথ তিনি পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিয়ে ট্রেন ধরতেন কুষ্টিয়া, মুন্সিগঞ্জ বা চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার জন্য।
সে সময় লেখা পড়ার পরিবেশ ছিল খুব সুশৃঙ্খল, সুনিয়ন্ত্রিত ও নিয়মিত । তার বড় সন্তান কাদেরুজ্জামান অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত জোড়াদহ মকুলে অধ্যায়নকালে পিতার ছাত্র ছিলেন। তিনি ক্লাসে পড়াশুনার ব্যাপারে কোন ছাড় দিতেন না। সন্তানকেও যথেষ্ট মারধোর করতেন পড়াশুনা গাফলতির কারনে। সকুলে তিনি উপরের ক্লাসেও পড়াশোনা না পারলে শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। যা কিনা আজকে ছাত্ররা কল্পনাও করতে পারে না। সে সময়ের ভায়নার বদরুল সা্যর, রামনগরের আজিজ স্যার, আনোয়ার স্যার কিভাবে ক্লাসে ছাত্রদের পড়াতেন এবং তাদের থেকে পড়া আদায় করে নিতেন সেটি এখন রীতিমত ইতিহাস হয়ে আছে। তিনি কঠোরতা ও কোমলতার পরশে ছাত্রদের আপন করে নিতে পারতেন পিতার মত করে।
আনোয়ার আলী মিঞা ইংরেজী, অংক, ইতিহাস ও ভূগোলের জ্ঞান তৎকালিন সময়ের ছাত্রদেরকে অবাক করে দিত। ইংরেজী ও অংকে পারদর্শীতা এতদাঞ্চলে তাকে বিশেষ মহিমা দান করেছিল। তিনি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে অনেক মেধাবী ছাত্রদেরকে ঘবংভরবষফ এর ইংরেজী গ্রামার, যাবদ চক্রবর্তীর পাটীগণিত ও কে,পি বসুর এ্যালজাবরা শেষ করে দিতেন।
তিনি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ছিলেন। সব সময় আত্মীয় স্বজনের সুখ দুঃখের খবর নিতেন এবং সর্বদা তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। সহানীয় রাজনীতিতেও একসময় তিনি স্বক্রিয় ছিলেন। একাধিকবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান / মেম্বার হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি জমির বর্গাদারদের প্রতি ছিলেন খুবই সহানুভূতিশীল। কোন বছর ঠিকমত ফসল না হলে ফসলের অংশ ছেড়ে দিতেন। সাধারণ লোকের সঙ্গে মেশার তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। কিন' স্পষ্টভাষনের জন্য তিনি অনেক সময় ভুল ভাবে চিত্রায়িত হতেন। তিনি কোন হাঙ্গামা পছন্দ করতেন না । তাই তার ৬০ বিঘা জমির বিরুদ্ধে হরিশপুরের এক সহানীয় ব্যক্তি কোর্টে মামলা করলে ৩৫ বৎসর তিনি মামলা চালিয়ে গেছেন। কিন' সহানীয় লোকজন দ্বারা তাকে কোন সময় অপদসহ হতে দেননি। দীর্ঘ সময় মামলা পরিচালনা করে বিজয়ী হয়ে তবেই এই জমির দখল তিনি বুঝে নিয়ে ছিলেন।
তার প্রায় ৮৫ (পচাঁশি) বৎসরের জীবন ইতিহাস খুব বৈচিত্র পূর্ণ। জীবনে তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। নিজের সুখ শান্তি ত্যাগ করেছেন। অস্বাভাবিক পরিসিহতি মুকাবেলা করেছেন শুধু সন্তান শুভাক্ঙ্ক্ষীদের ভবিষ্যতের শিক্ষা, সুখ, শান্তি ও জীবনের প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য। তিনি দুরারোগ্য লিভার ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৮ সালের ২৭শে মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মহান প্রভুর পাড়ি জমান। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। এসময় তিনি নিজ গ্রামের পারিবারিক কবর স'ানে দাফনের জন্য অসিয়ত করেন। তার অসিয়ত অনুযায়ি তাকে বেলতলা গ্রামের পারিবারিক কবর স'ানে সমাধিসহ করা হয়।
জ্ঞান তাপষ মাস্টার আজিজুর রহমান-(১৯১৭-২০১২)
আজিজুর রহমান ( আজিজ মাস্টার) ১৩২৯ বঙ্গবাদে ২১ বৈশাখ বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার রামনগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা দানেস আলী বিশ্বাস তৎকালিন সময়ে শিক্ষিত এবং সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মাতা আজিরন নেসাও স্বশিক্ষিত এক মহিয়সী রমনী ছিলেন্।
শিক্ষা জীবন ঃ প্রাথমিক শিক্ষাঃ ১৯৩১-১৯৩৪ সাল ভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় (১ম শ্রেণী হতে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত)।
নিম্ন মাধ্যমিক - ১৯৩৫-১৯৩৬ সাল হরিণাকণ্ডু এম.ই স্কুল ( ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত)
মাধ্যমিক শিক্ষা- ১৯৩৭-১৯৪০ সাল ফুলহরি হাই স্কুল (৭ম শ্রেণী হতে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত এবং ঐ স্কুলের খ্যাতিমান ছাত্র হিসাবে উত্তীর্ণ (বৃহত্তর যশোর জেলার ৩ জন ডিস্ট্রিংশন প্রাপ্তদের মধ্যে একজন তিনি।)
অন্যান্য গবেষণাঃ কলকাতা অবস'ান কালেই ১৯৪২-১৯৪৩ সালে সুফীবাদ, সন্ন্যাসবাদ ও বাউল ধর্মের উপর নতুলনা মূলক প্রচুর লেখাপড়া ও গবেষণা চালান ।
অন্যান্য সাফল্যঃ কলকাতা ক্রীড়াঙ্গনে তার বিচরন ছিল উল্লেখ করার মত। প্রেসিডেন্সী কলেজ ফুটবল টিমের অন্যতম ফুটবলার হিসাবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। কথিত আছে তাঁর ডাইরেক্ট কিক্ নিকট থেকে মোকাবলা করার সাহস কারো ছিল না। প্রচন্ড গতিতে তিনি কিক্ দিতে পারতেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত উভয় বাংলা সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১ম স'ান অধিকার করেছিলেন। এ ছাড়াও আরও অনেক কৃতিত্ব অজানা রয়ে গেছে ( প্রচার বিমুখিতার কারনে যা বলতে চাননিা)।
কর্মজীবন ঃ ১৯৪৩ সালে বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে টিএন্ডটি বিভাগে শিয়ালদাহে যোগদান করেন। পরে উক্ত চাকরিতে ইস্তফা দেন। ১৯৪৪ সালে পার্বতীপুর জুনিয়র মাদরাসায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান এবং ১৯৪৫ সালের ১৬ই জানুয়ারী পার্বতীপুর হাই স্কুলের জন্ম লগ্ন হতে অংক ও ভূগোলের স্বনামধন্য শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর জোড়াদহ হাই স্কুলে যোগদান করে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় এখানেই অতিবাহিত করেন। এরপর ১৯৬৭-৬৮ সালে আবারও পার্বতীপুর হাই স্কুলে ফিরে এসে বেশ কয়েক বছর এখানে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৭২-৭৩ সালে আবারও জোড়াদহ হাই স্কুলে প্রত্যাবর্তন এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত জোড়াদহ হাই স্কুলে দায়িত্ব পালন কালে অবসর গ্রহণ করেন। সুদীর্ঘ ৫৩ বছর শিক্ষকতা পেশায় অতিবাহিত করেন। তাঁর অসংখ্য কৃতিমান ছাত্র-ছাত্রী দেশে -বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন।
পারিবারিক জীবন ঃ ১৯৪৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ১০ পুত্র ও ৫ কন্যার জনক। পুত্রদের মধ্যে অনেকেই সরকারী/আধা-সরকারী সংস'ায় পদস' কর্মকর্তা হিসেবে সুনামের সাথে কর্মরত আছেন।
গবেষণা ও ধর্মপ্রচার ঃ মাস্টার আজিজুর রহমান তাঁর পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম বিষয়ে ব্যাপক পড়ালেখা ও গবেষণামূলক কাজ চালিয়ে যান। তাঁর লেখা ছোট-বড় ৯ খানা পুস্তক/পুস্তিকার পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। নিজে প্রচার বিমূখ হওয়ায় তা প্রকাশিত হয়নি। অচিরেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) স্বভাবিক মানুষ রাসুল বইটি প্রকাশিত হবে বলে আশা করা যায়। তিনি দীর্ঘদিন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে হরিণাকুণ্ডু, শৈলকুপা ও বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্ম প্রচার করেছেন। সভা-সমিতি ও ওয়াজ-মাহফিলে তিনি অনলবর্ষী বাগ্মিতার অধিকারী ছিলেন। ধর্ম বিষয়ে যুক্তি-তর্কেও তিনি ইসলাম ধর্মের মৌলিকত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন বলে কথিত আছে। কিছুদিন তিনি কুষ্টিয়াস' সর্ব ধর্ম গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।
শেষ জীবনঃ বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি নিজ গ্রামের বাড়ীতে কয়েক বছর শয্যাশায়ী অবস'ায় দিন যাপন করেন। কিছুটা স্মৃতিভ্রম হলেও অনেক বিষয়ে তখনও ভাল মত বলতে পারতেন। কিন' নিজে প্রচার বিমূখ হওয়ার কারণে সব কথা বলতে চাননি। মতাদর্শগত মিল খুঁজে পেলে তার সাথেই কেবল মন খুলে কথা বলতেন। বেশীর ভাগ সময় চুপচাপ থাকতে ভালবাসতেন। শেষ জীবনে বার্ধক্যজনিত রোগে কিছুদিন অসুস'্য থাকার পর অবশেষে ২০ডিসেম্বর ২০১২ সালে ইহজাগতিক মায়া ত্যাগ করে মহান প্রভুর দরবারে পাড়ি জমান।
লেখক-সাহিত্যিকঃ ড.খোন্দকার রিয়াজুল হক (লালন গবেষক), খোন্দকার রফি উদ্দীন (ভাব সঙ্গীত গ্রন্ত্রের রচয়িতা), খোন্দকার কেরামত আলী (প্রাবান্ধিক), আলী হাবিব (কলামিষ্ট ও রম্য লেখক), আশরাফুল ইসলাম (কলামিষ্ট ও প্রাবন্ধিক), টিপু সুলতান বারী ( কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক) , টোকন ঠাকুর (কবি), মোসলেম উদ্দীন ( কবি ও প্রাবন্ধিক), আব্দুল্লাহ মাসুদ ( কবি ও প্রাবন্ধিদক) আব্দুল্লাহ মারুফ ( কবি), সোহেল এইচ রহমান ( ছোট গল্প ও স্মুতিকথা), খোদা বখ্স ( কবি, ছোট গল্পকার) অনির্বান খালিদ ( কবি) মাহবুব মুরশেদ ( প্রাবন্ধিক ও গবেষক) এনামূল হক (কবি), শামসুলর আলম টুকু(কবি), শাহনেওয়াজ আলম মিঠু ( কবি), মতিয়ার রহমান (কবি)।
সাংবাদিকঃ আলী হাবিব (কালেরকণ্ঠ), আশরাফুল ইসলাম (দৈনিক ইত্তেফাক), ইমদাদুল হক বিশ্বাস ( রূপালী বাংলাদেশ) মাহবুব মুরশেদ (নয়াদিগন্ত), সাইফুজ্জামান ( মানবজমিন), মাহফুজুর রহমান (বাংলাদেম সময়), শাহানুর আলম (দৈনিক ইত্তেফাক), নাজমূল আহ্সান ( নিউজ টুডে), এইচ, মাহবুব মিলু (নতুন বার্তা), আহ্সান হাবিব, রবিউল ইসলাম (করতোয়া) সাইফুল ইসলাম( সময়ের কাগজ), মোস্তাফিজুর রহমান ( ঝিনাইদহ ২৪ ডটকম), তৈয়বুর রহমান (আরশীনগর), সৌরভ হোসাইন (নতুন খবর), বিপ্লব হোসাইন (রূপালী বাংলাদেশ), জাফিরুল ইসলাম ( আমাদের সংবাদ) ।
লেখকঃ শিক্ষক ও গবেষক।
তথ্য সূত্রঃ
ক) জেলা-উপজেলা প্রশাসনের ওয়েব সাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য।
খ) হরিণাকুণ্ডু নামের ইতিকথা।
গ) এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত তথ্য।
ঘ) বাংলা পিডিয়া প্রকাশিত তথ্য।
ঙ) বাউল কবি লালন শাহ- ড. আনোয়ারুল করিম।
চ) লালন পরিচিতি অধ্যাপক আবু তালিব।
ছ) লালন শাহ জীবন ও গান- ড. এসএম লুৎফর রহমান।
জ) মরমী কবি পাঞ্জু শাহ- জীবন ও কাব্য- ড. খোন্দকার রিয়াজুল হক ।
ঝ) লালন শাহের পূন্যভূমি হরিশপুর- ড. খোন্দকার রিয়াজুল হক।
ঞ) লালন অনুগামী দুদ্দু শাহ- কুস্টিয়া সরকারি কলেজ কর্তৃক প্রকাশিত সাহিত্য ম্যাগাজিন ।
ট) লালন- ১২৬তম তিরোধান বার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা।
ঠ) লালন-১২৭তম তিরোধান বার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা।
ড) চরিতাভিধান- বাংলা একাডেমী।
ঢ) ঝিনাইদহের ইতিহাস- জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত।
ণ) ১৯৭১ ঝিনাইদহের রনাঙ্গন-সুমন শিকদার সম্পাদিত।
ত) ঝিনাইদহের লিখিয়েরা-হাশিম মিলন।
থ) লালন ভূমি পত্রিকা- মোসলেম উদ্দীন সম্পাদিত।
দ) একুশের ভোর সামযিকী।
ধ) মাহে নও পত্রিকা ভাদ্র সংখ্য-১৯৫৩।
মাহবুব মুরশেদ শাহীন
নামকরণঃ- দেশের দক্ষিণ পশ্চিম জনপদের প্রবেশদ্বার খ্যাত ঝিনাইদহ জেলার একটি উপজেলা হরিণাকুণ্ডু। হরিণাকুণ্ডু নামকরন নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মত উপস'াপন করা হল-
আশির দশকের পূর্ব পর্যন্ত স'ানীয় লোকজনের নিকট হরিণাকুণ্ডুর পরিচিত ছিল হন্যেকুড়ো বলে। যেমন হরিণাকুণ্ডুর বাজারকে স'ানীয় লোকজনের নিকট হণ্যোকুড়োর হাট নামে বহুল প্রচলিত ছিল। এক সময় এখানে প্রচুর হরিণের বসবাস ছিল বলে প্রবীণরা আলাপচারিতায় প্রকাশ করে থাকেন।। সেই হরিণ থেকে হরিণা আর কুড়ো অর্থ রাশি-রাশি, গাদি-গাদি। সব মিলিয়ে হরিণের পাল যেখানে অভয় অরণ্য রুপে বসবাস করত সেই থেকে হন্যোকুড়ো নামটি প্রচলিত হয়েছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন। যা আধুনিক কালে হরিণাকুণ্ডু নামে পরিচিতি লাভ করে।
বৃটিশ বেনিয়া কোম্পানির নীল কুঠিয়াল ইংরেজ সাহেবের হিরণ নামক এক কন্যা কুণ্ডু (মিষ্টি) ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে প্রেম করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ইংরেজ সাহেব এতে অপমান ক্ষুব্ধ হয়ে এদেশ ছেড়ে চলে যান। কালক্রমে হিরণ-কুণ্ডুর প্রেমকাহিনী থেকে বর্তমান রূপ হরিণাকুণ্ডু পরিণত হয়েছে বলে একটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে।
আবার ভিন্ন মতের সর্মথনকারীদের অভিমত- হন্যোকুড়ো নামকরণের মধ্যে দুটি শব্দ বিদ্যমান। প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল এটি হিরণ যার অর্থ স্বর্ণ আর অপরটি কুড়ো অর্থ কুণ্ডু। যা স'ানীয় ভাষায় রাশি-রাশি, গাদি-গাদি বা প্রাচুর্যের সমাহার বুঝান হত। প্রাচীনকালে হয়ত কোন এক সময় এখানে সোনার আমদানী রফতানি ব্যবসার প্রচলন ছিল। আর সেই থেকে হন্যোকুড়ো নামের উৎপত্তি হয়ে আধুনিক কালে হরিণাকুণ্ডু রূপ লাভ করেছে।
সর্বশেষ ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত ঐতিহ্যবাহী ঝিনাইদহ গ্রনে' হরিণাকুণ্ডুর নামকরণ অংশে বলা হয়েছে-“জমিদার হরিচরণকুণ্ডুর নাম অনুসারে হরিণাকুণ্ডু নামকরণ গৃহিত হয়েছে”। এবিষয়ে লোকমুখে প্রচলিত আছে-অভয়কুণ্ডু নামে এক ইংরেজ কর্মচারী অর্থ আত্মসাৎ করে জমিদারী খরিদ করেন। তিনি তার অত্যাচারী পুত্র হরিচরণকুণ্ডুর নামানুসারে হরিণাকুণ্ডু নামের প্রচলন করেন।
আয়তন ও অবস'ানঃ - হরিণাকুণ্ডু উপজেলা ২২৭.৬২ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট। উপজেলাটির দক্ষিণে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা, উত্তরে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা, পূর্বে শৈলকূপা উপজেলা এবং পশ্চিমে আলমডাঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা পরিবেষ্টিত। হরিণাকুণ্ডু, পারবতীপুর ও শুড়া তিনটি মৌজার সমন্বয়ে ২০০২ সালে হরিণাকুণ্ডু পৌরসভা গঠন করা হয়। পৌর শহরটির অয়তন ১৯.৯৭ বর্গ কিলোমিটার। সর্বমোট একটি পৌরসভা, ৮টি ইউনিয়ন, ৭৭টি মৌজা ও ১৩০টি গ্রামের সমন্বয়ে উপজেলাটি গঠিত।
জনসংখ্যাঃ- উপজেলার মোট জনসংখ্যা ১,৯৭,৭২৩ জন। পুরুষ ৯৯,২৮৫ এবং মহিলা ৯৮,৪৩৮ জন। ধর্মীয় জনগোষ্ঠির হিসেবে ১,৮৮,৬৮৩ জন মুসলমান, ৮,৭৪০ জন হিন্দু, ২৫ জন খৃষ্টান এবং অন্যান্য সমপ্রদায়ের ২৭৫ জন নাগরিক রয়েছে। জনসংখ্যার ঘনত্বের হার ৮৬৯ জন ( প্রতি বর্গ কিলোমিটার)। হাউজ হোল্ডিং সংখ্যা ৪৮,০৫০টি। এছাড়া ১টি আদর্শ গ্রাম এবং আশ্রয়ন প্রকল্পের আওতাধীন ১টি গুচ্ছ
গ্রাম ও কালাপাহাড়িয়ায় একটি আবাসন প্রকল্প রয়েছে। এখানকার জনগোষ্ঠির সাক্ষরতার হার ৪৮.৪০%।
জাতির শ্রেষ্ট সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিসংখ্যাঃ
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ২০০১ সালে প্র্রকাশিত তালিকায়- ১৩৮ জন।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ২০০৫ সালে ২১ মে প্র্রকাশিত তালিকায় আরো সংযুক্ত- ৬১ জন।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ২০০৫সালে ১ ডিসেম্বর প্র্রকাশিত তালিকায় আরো সংযুক্ত-১৬ জন।
====================================================
তিন তালিকা মিলে সর্বমোট- ২১৫ জন।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাঃ
নয়জন মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদদের নামের তালিকা ঃ
ক্রমিক নং নাম পিতার নাম গ্রাম
০১ শহীদ নবীছ উদ্দীন খোরমেদ আলী ফতেপুর
০২ ” ইজাল উদ্দীন বিশ্বাস মৃত ঃ আবজাল আলী বিঃ শ্রীপুর
০৩ ” মহাম্মদ আলী মালিথা মৃতঃ নাজের আলী মালিথা রঘুনাথপুর
০৪ ” তোয়াজ উদ্দীন মন্ডল মৃতঃ মঙ্গল মন্ডল ভাদড়া
০৫ ” এলাহী বক্স মৃতঃ আতোর আলী বড় ভাদড়া
০৬ ” দোস্তর আলী করিম মন্ডল কন্যাদহ
০৭ ” কাদের আলী মৃত ঃ গফুর আলী শাহ জোড়াদহ
০৮ ” রেজাউল ইসলাম মৃত ঃ গোলাম মহিউদ্দীন ভায়না
০৯ ” আমোদ আলী মৃত ঃ শুকুর আলী জোড়াদহ
সম্মানী ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা-২০৪ জন।
বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা- ৫,৩৪৮ জন।
বিধবা ভাতাভোগীর সংখ্যা-২,৭৫৪ জন।
প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা- ১,২৫২ জন।
প্রতিবন্ধী শিক্ষা ভাতাভোগীর সংখ্যা-১০০ জন।
রেজিস্ট্রার্ড প্রতিবন্ধীর সংখ্যা- ৩০৫৪ জন (আইডি কার্ড প্রাপ্ত)।
ভিক্ষুক সংখ্যা- ৩৯৯ জন।
পুরুষ ভিক্ষুক- ১৫১ জন।
মহিলা- ২৪৮ জন।
(এ সকল ভিক্ষুকদর পূনর্বাসন কার্যক্রম চলমান)।
প্রশাসনঃ-ইংরেজ শাসন আমলে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হরিণাকুণ্ডুতে থানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন' অত্যাচারী জমিদারদের শোষন-শাসন বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় তাদের বিরোধিতার কারণে সে সময় এখানে থানা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী পারবতীপুর গ্রামের বিশিষ্ট কিছু নাগরিকবৃন্দ থানা প্রতিষ্ঠার জন্য জমিদানে সম্মত হলে ১৮২৭ সালে বর্তমান অবস'ানে থানা ও পাশাপাশি পোষ্ট অফিস প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ১৮৫৭ সালে ২.২৮ একর জমি থানা ও পোষ্ট অফিসের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। অবশেষে ১৮৬৩ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে হরিণাকুণ্ডুতে থানা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে হরিণাকুণ্ডু থানার সংগৃহিত রেকর্ড অনুয়ায়ি ১৯১৭ সালে ১ মার্চ যশোর পুলিশ অফিসের পিডিএসআই জনাব উজির উদ্দিন উক্ত স'ানে থানার ঘোষণাপত্র অনুমোদন দান করে স্টাফ প্রেরণের মাধ্যমে থানার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করান।
পুরাকৃতি ও ঐতিহাসিক নিদর্শনঃ- হরিণাকুণ্ডু, জোড়াদহ, ভায়না, ধূলিয়া, হিংগারপাড়া ও সোনাতনপুরে নীলকুঠির ভগ্নাবশেষ, হরিশপুরে ফকির লালন শাহ’র ভিটে, লালন দীক্ষাগুরু দরবেশ সিরাজ সাই’র মাজার, পাঞ্জু শাহ’র মাজার, বেলতলায় দুদ্দু শাহ’র মাজার, রিশখালীতে বিপ্লবী বাঘা যতীনের পৈত্রিক ভিটা, কুলবাড়িয়ায় ফকির মাহমুদ বিশ্বাসের বাগান বাড়ি ও মাজার, দিগনগর কুমোর রাজার বাড়ির স্মৃতি চিহ্ন বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঐতিহাসিক ঘটনাঃ- বিপ্লবী বাঘা যতীন এবং কেরান রায় নামে দুজন দেশ প্রেমিক নাগরিক বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাদের নেতৃত্বেই এখানকার জনসাধারণ নীল চাষ প্রতিরোধ আন্দোালন গড়ে তোলেন।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানঃ- মসজিদ- ২৬০টি, মন্দির-১৬টি, গীর্জা-১টি, অন্যান্য উপাসনালয়- ১টি এবং ৫টি সৌধ রয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে- শ্রীপুর জামে মসজিদ, জোড়াদহ গম্বুজ মসজিদ, শীতলী জোয়ার্দার বাড়ি জামে মসজিদ ও হেফজখানা কমপ্লেক্স, পারবতীপুর থানা জামে মসজিদ, উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদ, হরিণাকুণ্ডু বাজার জামে মসজিদ, আন্দুলিয়া জামে মসজিদ, বলরামপুর জামে মসজিদ, কুলবাড়িয়া ফকির মাহমুদ বিশ্বাসের বাগান বাড়ি জামে মসজিদ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া পাবতীপুর বাজার মাতৃ মন্দির ও ভবানীপুর কালি মন্দির বিশেষ ভাবে পরিচিত।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ- প্রাথমিক বিদ্যালয়-১৪০টি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-১৩৫টি এবং রেজিস্ট্রার প্রাথমিক বিদ্যালয়-৫টি।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ঃ-৪০টি। হরিণাকুণ্ডু সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ১টি, বেসরকারি এমপিও ভূক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়-৩৪টি এবং এমপিও বিহীন মাধ্যমিক বিদ্যালয়-৫টি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জোড়াদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৮৭২), হরিণাকুণ্ডু প্রিয়নাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৮৭২), হরিণাকুণ্ডু মাধ্যমিক (পাইলট) বিদ্যালয় (১৯৪৫) এবং শিশুকলি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৯৯৫) বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ।
কলেজঃ- ৬টি। সরকারি লালন শাহ কলেজ (১৯৯৭২)। এছাড়া ৫টি বেসরকারি কলেজ রয়েছে। এগুলো হলো- সালেহা বেগম মহিলা ডিগ্রি কলেজ (১৯৯৬), হাজি আরসাদ আলী ডিগ্রি কলেজ (১৯৯৫), জোড়াদহ কলেজ (২০০০), মান্দিয়া আইডিয়াল কলেজ (১৯৯৮), বঙ্গবন্ধু কারিগরী কলেজ (২০০৫)। মাদ্রসা-১২টি। এমপিও ভূক্ত ৭টি এবং এমপিও বিহীন ৫টি।
স্বাস'্য সেবাঃ- উপজেলাবাসির স্বাস'্য সেবা প্রদানের লক্ষে উপজেলা সদরে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি স্বাস'্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র-৬টি, স্বাস'্য সেবা কেন্দ্র-১১টি এবং ২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। উপজেলা হেডকোয়াটারে একটি সেবিকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও আছে।
কুটির শিল্পঃ তাত-৫০০টি, দর্জি-২৮০টি, হস্তশিল্প কেন্দ্র ৫টি, কাঠের শিল্প-১১৫, বাঁশের কাজ -১০,স্বর্ণকার ২০টি, কর্মকার-২৫।
প্রধান রফতানিযোগ্য ফসলঃ- ধান, চাউল, পান, পাট, খেজুর গুড়, চিনি, সবজী ইত্যাদি।
হাট বাজারঃ-২৬টি হাট বাজারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-হরিণাকুণ্ডু, পারবতীপুর, কুলবাড়িয়া, ভবানীপুর, জোড়াদহ, মান্দিয়া, ভায়না, রঘুনাথপুর, পাখিমারা, পোড়াহাটি, শাখারীদহ, সাতব্রীজ, নারায়নকান্দি, দখলপুর, শীতলী, চারাতলা, মথুরাপুর, ফলসী, হরিশপুর লালন বাজার, রিশখালি, সোনাতনপুর, ভালকী, চাঁদপুর, বন্যাতলা, সড়াবাড়িয়া নিউমার্কেট উল্লেখযোগ্য।
সাংস্কৃিিতক সংগঠনঃ-ক্লাব-২৫টি, গনগ্রন'াগার ১টি, সিনেমা হল ৩টি।( বর্তমানে সব বন্ধ) সাহিত্য সমিতি-৩টি, থিয়েটার গ্রূপ-৪টি, অপেরা গোষ্ঠী-১টি, ক্রীড়া ক্লাব ১২টি।
পত্রপত্রিকাঃ-লালনভূমি নামে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ২০১৫ সাল থেকে লালন শাহ’র জন্মভূমি হরিশপুর থেকে লালন স্মরণোৎসব উপলক্ষে বাৎসরিক ভাবে লালন নামে একটি স্মারক গ্রন' প্রকাশিত হয়ে আসছে। এছাড়া চলন্তিকা নামে একটি সাহিত্য সাময়িকী ২/১টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে অছে।
প্রধান পেশাঃ- কৃষি-৫৪.৯৩%, কৃষি শ্রমিক-২৫.৭৪%, মজুর শ্রমিক-১.৭২%, ব্যবসা বাণিজ্য-৭.৫৪%, চাকুরে-২.৩১% এবং অন্যান্য- ৭.৭৫%।
ভূমির ব্যবহারঃ-আবাদযোগ্য জমির পরিমান-২২,২৭৩ হেক্টর। বর্তমান আবাদযোগ্য-১৬৫০০ হেক্টর, অনাবাদী-৬২২৩ হেক্টর। স'ায়ী পতিত-৬০০ হেক্টর, জলাশয়-৮০০ হেক্টর। স'ায়ী ফল বাগান-৬০ হেক্টর, স'ায়ী বনায়ন- ১০০ হেক্টর, শহর অঞ্চল-৫০০ হেক্টর, গ্রাম অঞ্চলের ঘরবাড়ি- ৩০০০ হেক্টর, এছাড়া রাস্তা-স'াপনা-অবকাঠামো রয়েছে- ১১৬৩ হেক্টর জমি।
ভূমির ব্যবহারঃ- নীট ফসলী জমির পরিমান-১৬০০ হেক্টর, এক ফসলী- ১২০০ হেক্টর, দোফসলী- ৯৩০০ হেক্টর, তিন ফসলী-৬০০০ হেক্টরসহ মোট ফসলী জমির পরিমান দাড়ায় ৩৭৮০০ হেক্টর। এছাড়া গঙ্গা কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের আওতায় ৪০০০ হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পেয়ে থাকে।
ভূমির নিয়ন্ত্রনঃ-ভূমিহীন-২৩%, ক্ষুদ চাষি-৩৬% এবং মাঝারী চাষি-২৭%, এবং বড় চাষি-১৪% ভূমি নিয়ন্ত্র করে থাক্ে।
ভূমি ব্যবহারের নিবীড়তা-২২৯%, ব্যবহারের ঘনত্ব- ৪৩%।
নদী ও বাওড়ঃ- উপজেলাটির মধ্য দিয়ে কুমার ও নবগঙ্গা নামে দুটি নদী এবং নারায়নকান্দি, কাপাসহাটিয়া ও চাঁদপুরে তিনটি বাওড় অবসি'ত।
কুমার নদী- চুয়াডাঙ্গা জেলার হাটবোয়ালিয়ায় মাথাভাঙ্গা নদী হতে উদ্ভুত একটি নদী। বর্ষা মৌসূমে পানি পূর্ণ থাকলেও শুষ্ক মৌসূমে নদীটি শুকিয়ে যায। আশ পাশের অনেক বিলের পানি বয়ে আনার ফলে এ নদীর পানির রং ছিল অনেকটা কাল। এ কারণে স'ানীয় লোকজনের নিকট এ নদী কালো বিল বলে পরিচিত। উৎপত্তি স'ল থেকে কুমার বর্তমানে নবগঙ্গার প্রায় সমান্তরালে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। মাগুরার কাছে নবগঙ্গার সাথে মিলিত হয়ে মিলিত স্রোত নবগঙ্গা নামেই দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। কুমার এক সময় কালিগঙ্গা, ছাকু, হানু, মুচিখালি ইত্যাদি থেকে তার অধিকাংশ প্রবাহ পেত। উল্লেখিত সব কটি নদীই গড়াই এর শাখা। গঙ্গা কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে মাথাভাঙ্গা থেকে কুমারের উৎস মুখ এবং অন্যান্য নদী নালাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। উৎস মুখগুলি বন্ধ করে দেওয়ায় কুমার বর্তমানে একটি ক্ষীণকায় নদীতে পরিণত হয়েছে। কেবল গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের প্রয়োজনাতিরিক্ত পানি এবং স'ানীয় বৃষ্টিপাতই এখন এই নদীর জল প্রবাহের প্রধানতম উৎস। হাটবোয়ালিয়ায় উৎপন্ন হওয়ার পর কুমার প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ঝিনাইদহ জেলার সীমানা বরাবর এসে শৈলকূপা উপজেলায় প্রবেশ করেছে এবং মাগুরা জেলা শহরের কাছে নবগঙ্গায় পতিত হয়েছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ প্রায় ১৪৪ কিলোমিটার। আলমডাঙ্গা, হরিণাকুণ্ডু, শৈলকূপা, শ্রীপুর, মাগুরা প্রভৃতি কুমার নদীর তীরবর্র্তী উল্লেখযোগ্য স'ান।
নবগঙ্গা- মাথাভাঙ্গা নদীর একটি শাখা, চুয়াডাঙ্গা শহরের নিকট এর উৎপত্তিস'ল। মাথাভাঙ্গা থেকে গঙ্গার নবরূপ- এভাবে নবগঙ্গা নামকরণ করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয। চুয়াডাঙ্গার কাছ থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হওয়ার পর মাগুরাতে কুমার এবং নড়াইলে চিত্রা নদীর জলাধারসহ এটি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব নদীতে পড়েছে। পূর্বে ইছামতির শাখা নদী ছিল। কিন' উৎস মুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে ভৈরব নদীর একটি উপ-নদীতে পরিণত হয়েছে। নদীটি নাব্য ও জোয়ারভাটা দ্বারা প্রবাহিত। উৎস মুখ হতে পূর্ব দিকে কিছু পথ যাওয়ার পর একটি বিলের মাঝে নবগঙ্গা পথরুদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৩০ সালে এই ভরাট মুখের সংস্কার করা হয়। কিন' এই সংস্কারের ফলেও নবগঙ্গার উৎস মুখের কোন পরিবর্তন হয়নি। এ স'ানটি গজনভী ঘাট নামে পরিচিত। চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলা অতিক্রম করে মাগুরার কাছে কুমার নদীতে যেয়ে মিশেছে। বস'ত মাগুরার পরবর্তী নবগঙ্গা কুমার নদীরই বর্ধিত সংস্করণ।
সামপ্রতিক সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, গড়াই মধুমতির মূল স্রোতের অধিকাংশই বরদিয়াতে নবগঙ্গা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীটির মোট দের্ঘ্য ২৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলার অংশ ২৬ কিলোমিটার। নবগঙ্গার সমগ্র পথ আঁকা বাঁকা হলেও ভাঙ্গন প্রবণ নয়। চুয়াডাঙ্গা থেকে মাগুরা পর্যন্ত পথ অনাব্য এবং জলজ উদ্ভিদে পরিপূর্ণ। তবে বর্ষা মৌসূমে দুই তিন মাস নৌকা চলাচলের উপযোগি থাকে। মাগুরার নিম্ন অঞ্চল সারা বৎসরই নাব্য। মাগুরা পর্যন্ত এই নদীর গড় প্রস' ২০০ মিটার এবং পরবর্তী
অংশের গড় প্রস' ৩০০ মিটার। মাগুরা পরবর্তী অংশ নিয়মিত জোয়ারভাটা দ্বারা প্রভাবিত। জোয়ারভাটার গড় পরিসর প্রায় ১ মিটার।
চুয়াডাঙ্গা থেকে গাজীরহাট পর্যন্ত বিভিন্ন স'ানে পাম্পের সাহায্যে এই নদীর পানি সেচকার্যে ব্যবহারিত হচ্ছে। মাগুরাতে একটি সেতু নির্মান করে এর সাহায্যে উজান অংশে সেচ কার্য পরিচালনা করা হচ্ছে। কালাচাঁদপুর থেকে গাজীরহাট পর্যন্ত নদীর ডানতীরে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের আওতায় এই জলকাঠামো এবং বাঁধটি ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে।
ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, বিনোদপুর, সূত্রাজিতপুর, নওহাটা, শিংগিয়া, নলমি, রায়গ্রাম লক্ষীপাশা, লোহাগড়া, বরদিয়া, গাজীরহাট প্রভৃতি নদীর তীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স'ান।
প্রধান ফসল- ধান, পাট, কলা, গম, পান, ভূট্রা, মসূরী, ছোলা, মরিচ, পিয়াজ, রসুন, সরিষা, বেগুন, আলুসহ বিভিন্ন প্রকারের সবজী চাষ করা হয়।
ফলঃ-আম, কাঠাল, নারিকেল, লিচু, কলা, বেল, তাল, সবেদা, কুল, পিয়ারা, জামরুল, কালো জাম, জাম্বুরা, বাতাবী লেবু ও কাগজী লেবু উল্লেখযোগ্য।
বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত ফসলঃ-তিসি, তিল, রাই সরিষা, কাউন, যব, বার্লি ও তামাক উল্লেখযোগ্য।
যোগাযোগঃ-উপজেলাতে ২৫০টি ছোট বড় রাস্তা রযেছে। যার দের্ঘ্য ৫১৩ কিলোমিটার। ২২০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৫৫ কিলোমিটার সলিং ও এইচএসবি এবং অবশিষ্ট ২৩৮ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা।
যানবহনঃ- বাস, ট্রাক, গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি, ভ্যান, পাখি ভ্যান (ইঞ্জিন চালিত), ইজি বাইক, আলমসাধু, নসিমন, করিমন, লাটা হাম্বার, ট্রলি, ট্রাক্টর, পিক-আপ ইত্যাদি।
বিলুপ্ত প্রায যানবহনঃ- পাল্কী, ডুলি, ঘোড়ার গাড়ি।
কারখানাঃ- চাউলের কল-৫৭টি, বরফ কল ২টি, বেকারী-৩টি, সমিল-১০টি, ওয়েল্ডিং ১১টি। এছাড়া অর্ধ ডজনের মত কারখানাতে চায়না ইঞ্জিনের সাথে স'ানীয় প্রযুক্তি যোগ করে বিভিন্ন গ্রামীণ পরিবহন খ্যাত যানবহন তৈরী করা হচ্ছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান- ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনাসহ আর্থিক লেনদেনের জন্য বেশ কয়েটি সরকারি বেসরকারি ব্যাংক গড়ে উঠেছে। সরকারি ব্যাংকগুলির মধ্যে সোনালী, জনতা , অগ্রণী, কৃষি এবং বেসরকারি
ব্যাংকের মধ্যে ডাচ-বাংলা, গ্রামীণ, ব্রাক ব্যাংক উল্লেখযোগ্য। এসকল ব্যাংক উপজেলা শহর ছাড়াও ইউনিয়ন এমন কি গ্রামীন জনপদ পর্যন্ত বিস-ৃত রয়েছে।
বিদ্যুৎ ব্যবস'াঃ- নব্বই দশকের মধ্যবর্তী সময় হতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় উপজেলা সদরের বাইরে বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাভূক্ত হওয়ার পূর্ব
পর্যন্ত উপজেলায় ১৬৪ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন নির্মানের ফলে ১৯% এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এসময় ৫১২৭ জন গ্রাহক (১২.৪৬%) বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পল্লী বিদ্যুতের মাধ্যমে ৬৯৯ কিলোমিটার লাইন নির্মানের ফলে ৮৩% এলাকায় বিদ্যুৎ সরবাহের মাধ্যমে ৩৬,৩৮০ জন গ্রাহককে ( ৯০%) বিদ্যুৎ সরবাহ নিশ্চিত করা হয়। ২০১৮ সালের মার্চের মধ্যে ৮৩৬ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মানের মাধ্যমে উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুৎ সরবাহ নিশ্চিত করার মাস্টার প্লান বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। উপজেলা সদরের দিগগনর এলকাতে সমপ্রতি ৩৩ কেভি ক্ষমতা সম্পন্ন একটি সাব স্টেশন নির্মানের মাধ্যমে গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ অনেকাংেশে নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হয়েছে।
কৃতিমান ব্যক্তি-
মহান সাধক ফকির লালন শাহঃ (১৭৭২-১৮৯০)
উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী মহান সাধক ফকির লালন শাহ ১৭৭২ সালে তৎকালিন বৃহত্তর যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার হরিণাকুণ্ডু থানার হরিশপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দরিবুল্লাহ দেওয়ান এবং মাতার নাম আমিনা খাতুন। পিতামহ ছিলেন গোলাম কাদির দেওয়ান। দরিবুল্লাহ দেওয়ানজির তিন পুত্র আলম, কলম এবং লালন।
১৭৭২-১৭৭৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিকৃত ভারত বর্ষের রাজধানী হয় কোলকাতা। ঠিক এই সময় স্যার জোসেফ প্রিস্টলি (১৭৩৩-১৮০৪) নামক এক ইংরেজ ধর্মযাজক, রসায়নবীদ ও দার্শনিক অক্সিজেন আবিষ্কার করে পৃথিবীবাসিকে চমকিয়ে দেন। আর অধিকাংশ গবেষকদের মতে ফকির লালন শাহ এ সময় কালেই জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তী কালে তিনি হয়ে ওঠেন স্বতন্ত্র ধারার এক মহান সাধক পুরুষ। লালন ছিলেন মানবতাবাদী। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চে স'ান দিয়ে ছিলেন। অসামপ্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেন। তার গান ও দর্শন যুগ যুগে প্রভাবিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অ্যালেন গিলবার্গের মত খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তার রচিত সহস্রাধিক গান মরমী চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ায় স'ানীয় লোকেরা এটিকে দেহতত্ব বা ভাব গান বলে আখ্যায়িত করে থাকে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্ব প্রথম লালন শাহকে মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ২০০৪ সালে বিবিসি’র শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচনের তালিকায় ফকির লালন শাহকে ১২তম স'ান দান করা হয়েছে।
এখানে একটি বিষয় বিশেষ ভাব্ সে্মরণ রাখা প্রয়োজন- লালন যখন জন্ম গ্রহণ করেন তখন উপমহাদেশে রাজনীতি ইংরেজ বেনিয়া কর্তৃক সম্পূর্ণ রুপে নিয়ন্ত্রিত। কুটকৌশলী ইংরেজরা হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে জাতিগত উস্কানী ছড়িয়ে দিয়ে বিভেদ সৃস্টিতে ছিল বিশেষ তৎপর। এক পক্ষকে আপন করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার নীতি অবলম্বন করে তারা। এ নীতিতে ইংরেজরা বলতে গেলে সম্পূর্ন রুপে সফলকাম হয়েছিল। হিন্দু সমপ্রদায় ইংরেজদের প্রিয়ভাজনে পরিণত হয়ে শিক্ষা, ব্যবসা বানিজ্যের মাধ্যমে অর্থ প্রতিপত্তি লাভ করে মুসলিমদের দাবি রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ফলে মুসলিম সমপ্রদায় শিক্ষা ব্যবসা বনিজ্য অর্থ সব দিক থেকে নিদারুন ভাবে পিছিয়ে পড়ে। এমন সময় সমগ্র বাংলার বুক জুড়ে অভিশাপ রুপে নেমে আসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। সবত্রই দেখা দেয় দুর্ভিক্ষের চরম হাহাকার। অভাবের তাড়নায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হয় বিপন্ন মানুষ। দরিবুল্লাহ দেওয়ানের পরিবারও এ করাল গ্রাসের থাবা মুক্ত হতে না পেরে নিজের জমি জায়গা বিক্রি করে পরিবার পরিজনের আহার জোগাতে থাকেন।
তিন ভায়ের মধ্যে বড় ভাই আলম জীবিকার তাগিদে কলিকাতা চলে যান। কৈশরে পিতার মৃত্যুর পর মেজো ভাই কলম পিতার রেখে যাওয়া সামান্য কিছু জায়গা জমি চাষ করে কায় ক্লেষে সংসার পরিচালনা করতে থাকেন। ছোট ভাই লালন ছিল সঙ্গীত প্রিয়, সংসার বিমূখ এক কিশোর। কুলবেড়ে হরিশপুর অঞ্চলে কোথাও গানের আসরের সংবাদ পেলে লালন সেখানে যেয়ে হাজির। কিন' অভাব গ্রস' মেজো ভাই কলম ছোট ভায়ের এ ছন্নছাড়া স্বভাবকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ভাই ভাবী মিলে সংসারের কাজে আত্ম নিয়োগ করার জন্য প্রতি নিয়ত লালনকে তাগিদ দিতে থাকে। কিন' উদাসীন লালন এসবে কর্ণপাত করতে নারাজ।
হরিশপুরের প্রবীণ ব্যক্তি মরহুম মুন্সী আব্দুল আজিজ ব্যক্ত করেন যে, ভায়ের অভাবের সংসারে বসবাসকালিন সময়ে ২১/২২ বছর বয়সে লালন পক্সজ্বরে আক্রান্ত হন। পরিবারের লোকেরা সেবা শুশ্রূষা করলেও নানা খুটা শুনতে শুনতে গুরুতর অসুস'্য লালন একদিন রাতের আঁধারে সকলের অজান্তে উদ্দশ্যহীন ভাবে বাড়ি ছেড়ে অজানার পথে বের হয়ে পড়েন। গুরুতর অসুস'্যতার কারনে বাড়ির অদূরে থানা ঘাটের নিকটবর্তী বাটিকামারির বিলের ধারে বটতলায় পৌছে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। প্রাতঃকালে একই পাড়ার রমনী সিরাজ সাঁই পত্নী বিলের ধারে পানি আনতে যেয়ে মুমূর্ষ অবস'ায় এক যুবককে পড়ে থাকতে দেখে গৃহে ফিরে স্বামীকে বিষয়টি অবহিত করেন। মানব দরদী সিরাজ সাই ক্ষীণকণ্ঠে গোঙানীরত লালনকে পাঁজাকোলা করে নিজ গৃহে নিয়ে এসে সেবা শুশ্রূষা করতে থাকেন। সিরাজ দম্পতির আন্তরিক সেবায় কিছু দিনের মধ্যে তিনি সুস'্য হয়ে উঠলেও তার একটি চোখ চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারায়।
রোগ মুক্তির পর সিরাজ সাই লালনকে তার নিজ গৃহে ফিরে যেতে নির্দেশ দিলে, সে বাড়ি ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। তিনি বলেন, যে সংসারে বিপদে আপন ভাইও পর হয়ে যায়, সে সংসারে আমি আর ফিরবো না। আপনি আমার নবতর জীবন দান করেছেন। আমি আপনার অধীন দাস হয়ে চিরদিন আপনার সেবা করতে চাই। আপনি দয়া করে আমাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করুন। কিন' সিরাজ সাই লালনের সামাজিক অবস'ান এবং বংশীয় মর্যদার কথা চিন্তা করে তাকে মুরিদ করে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, সে বিদ্যা বুদ্ধিহীন একজন নগন্য মানুষ মাত্র। সে কারনে গুরূপদের অযোগ্য। বরং তাকে একজন ভাল কামেল পীরের নিকট মুরিদ হওয়ার নিদের্শনা প্রদান করেন। কিন' নাছোড়বান্দা লালন সিরাজ দম্পতির আপত্য স্নেহ মমতা বাঁধনে চিরতরে আবদ্ধ হয়ে পড়ায় সিরাজ গৃহ ত্যাগ করে সে আর নিজ গৃহ কিম্বা অন্য কোথাও ফিরে যায়নি।
সংসার বিমুখ মিঠেকণ্ঠ লালনের মধ্যে অমিত সম্ভবনাময় প্রতিভার ঝিলিক দেখতে পেয়ে সিরাজ সাই পুত্র স্নেহে নিজ বাড়িতে পরম আদরে তাকে স'ান করে দেন। লালনও এরকম পিতৃতুল্য গুরু পেয়ে সর্বক্ষণ সিরাজ সাই’র একান্ত সান্নিধ্যে সময় অতিবাহিত করতে থাকেন। যে কারনে লালন তার অগনিত গানে দরবেশ সিরাজ সাইকে সশ্রদ্ধ চিত্তে সমরন করেছেন। লালন শাহ’র একটি গান এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে সমরন যোগ্য-
“গুরু তুমি পতিত পাবন পরম ঈশ্বর,
অখন্ড মন্ডলা কারং ব্যপ্তম জগৎ চরাচর।
ব্রক্ষ্মা বিষ্ণু শীব এই তিনে,
ভজে দয়াল নিশি দিনে।
আমি জানি না হে তোমা বিনে,
ওহে গুরু পরাৎপর।
ভজে যদি না পাই তোমায়,
এ দোষ আমি দিব বা কার।
দুটি নয়ন রাখি তোমার উপর,
যা কর তুমি এবার।
আমি লালন এক ষেঁড়ে
ভাই বন্ধু নাই আমার জোড়ে
ভূগে ছিলাম পক্সো জ্বরে
দরবেশ সিরাজ সাই করলেন উদ্ধার।”
এ গান থেকেই সপষ্ট বুঝা যায় লালন ও তার দীক্ষা গুরু দরবেশ সিরাজ সাই’র প্রকৃত পরিচয়। হরিশপুরে লালনের বসত ভিটার সন্নিকটে থানা ঘাটের অদূরবর্তী বাটিকামারি বিলের ধারে পক্সজ্বরে আক্রান্ত লালন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলে দরবেশ সিরাজ সাই যে তাকে উদ্ধার করে সেবাদানের মাধ্যমে সুস'্য করে তোলেন। উপরোক্ত গানটির মাধ্যমে সে কথা গভীর শ্রদ্ধাভরে তিনি স্মরন করেছেন। কিন' সামিপ্রক কালে আকাট্য যুক্তি এবং শক্তিশালী তথ্য প্রমান থাকার পরও উপরোল্লেখিত লালন গীতিটির বিকৃতি ঘটিয়ে দরবেশ সিরাজ সাই’র স'লে মলম শাহ সংযোজন করা হয়েছে। যা সত্য ইতিহাস বিকৃতির এক জঘন্যতম অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে সকল লালন জীবনীকারগন ২১/২২ বছর বয়সী যুবক লালনকে ছেউড়িয়ার কালিনদীর ধারে অজ্ঞান অবস'ায় পড়ে থাকার তথ্য উপস'াপনের ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছেন, তারা কোন ভাবেই উপরি-উক্ত লালন গীতিটিতে উল্লেখিত দরবেশ সিরাজ সাইকে ছেউড়িয়াতে উপস'াপন করার মত কোন যুক্তি তুলে ধরতে পারেননি। সে কারনে লালনের আত্ম পরিচয় তথ্য সম্বলিত সঙ্গীতটির বিকৃতি ঘটিয়ে মলম শাহ করলেন উদ্ধার তথ্যটি উপস'াপন করা হয়েছে। ঠিক এমন আর একটি সঙ্গীতে বলা হয়েছে-
সিরাজ সাঁই ফকিরের বানী
বুঝবি লালন দিনি দিনি,
শক্তি ছাড়া ভাবুক যিনি,
সে কি পাবে গুরুপদ॥
সাঁই সিরাজের হকের বচন,
ভেবে কহে অবোধ লালন,
দায়েমী নামাজী যে জন
সমন তাহার আজ্ঞাকারী ॥
অথচ লালন শাহ’র অসংখ্য গানের একটিতেও সিরাজ সাই ব্যতিত মলম শাহ কিম্বা অন্য কারুর নাম ভনিতা আকারে উল্লেখ করার কোন তথ্য প্রমানাদি অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি।
এছাড়া লালন ও তাঁর দীক্ষা গুরু দরবেশ সিরাজ শাহ’র জন্মস'ান হরিশপুর এ সম্পর্কীয় প্রাচীনতম অকাট্য বিবরণ পাওয়া যায। ঐতিহাসিক ও গবেষক মৌলভী আব্দুল ওয়ালী লিখিত একটি প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন-
“অহড়ঃযবৎ ৎবহড়হিবফ ধহফ সড়ংঃ সবষড়ফরড়ঁং াবৎংরভরবৎ যিড়ংব দউযুঁধহ' ধৎব ঃযব ৎধমব ড়ভ ঃযব ষড়বিৎ পষধংংবং ধহফ ংঁহম নু ইড়ধঃসবহ ধহফ ড়ঃযবৎং, ধিং ভধৎ ভধসবফ 'খধষড়হ ঝযধয'. ঐব ধিং ধ ফরংপরঢ়ষব ড়ভ ঝরৎধল ংযধয ধহফ নড়ঃয বিৎব নৎড়হ ধঃ ঃযব ারষষধমব ঐধৎরংযঢ়ঁৎ, ঝঁন-উরারংরড়হ- ঔবহরফধয, উরংঃৎরপঃ-লবংংড়ৎব.চ
[ঙহ ংড়সব পঁৎষড়ঁং ঞবহবঃং ধহফ ঢ়ৎধপঃরপবং ড়ভ পবৎঃধরহ পষধংং ড়ভ ঋধয়ঁরৎং রহ নবহমধষ-ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঃযব অহঃযৎড়, ঢ়ড়ষড়মরপধষ ঝড়পরবঃু ড়ভ ইড়সনধু-১৯০০. ঠড়ষ, ঘ০-৪: ৎবধফ ড়হ ৩০, ৯,১৮৯৮.]
অর্থ-“আর একজন বিখ্যাত গীতিকার যার ধুয়োগান নিম্ন শ্রেণির লোকদের অনুরাগের বিষয়। এ গান নৌকার মাঝিরা এবং অন্য সকলে গেয়ে থাকেন। ইনি হচ্ছেন বহু বিখ্যাত লালন শাহ্। তিনি ও তার পীর সিরাজ শাহ্ উভয়েই যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার অধীন হরিশপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।”
১৮৯৮খ্রিঃ শৈলকূপার সাব-রেজিস্ট্রার, প্রত্নতত্ত্ববীদ, ঐতিহাসিক ও এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য মৌলভী আব্দুল ওয়ালি একটি প্রবন্ধে উপরোল্লেখিত তথ্যটি প্রদান করেন। ১৯০০ খিষ্টাব্দে বোম্বের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে এটি প্রকাশিত হয়। মৌলভী আব্দুল ওয়ালী হরিণাকুন্ডু থানার পার্শ্ববর্তী শৈলকূপা থানার সাব-রেজিষ্ট্রার ছিলেন। সে সময়ে হরিণাকুন্ডুতে সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস না থাকায় ভূমি রেজিষ্ট্রি সংক্রান্ত কাজে হরিণাকুন্ডুবাসি অহরহ শৈলকূপাতে যাতায়াত করতেন। শৈলকূপা থানাটি হরিণাকুন্ডু থানা সংলগ্ন হওয়ায় আব্দুল ওয়ালী সাহেব প্রদত্ত তথ্যটি অধিকতর নির্ভূল এবং গ্রহণযোগ্যতার মাফকাঠিতে উত্তীর্ণ বলে সচেতন সুধি সমাজের অভিমত।
অধ্যাপক আবূ তালিব লালন পরিচয় সম্বলিত এক গবেষনায় উল্লেখ করেন-১৮৮১ সালের ১৯ জানুয়ারি তৎকালিন যশোর জেলার শৈলকূপা এলাকাধীন (বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার আলমডাঙ্গা গ্রাম) পরমানান্দপুর মৌজায় একটি আঁখড়াবাড়ি নির্মানের জন্য পাট্রা দলিলের মাধ্যমে জমি খরিদ করেন। দলিলে লালন শাহ’র পরিচয় কলামে বিবরণ দেওয়া হয়েছে এভাবে- শ্রী যুক্ত লালন সাই, পিতা সিরাজ সাই, জাতি মুসলিম, পেশা- ভিক্ষা। ঠিকানার বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছেঃ সাকিন-ছেউড়ে, ভ্রামিপুর, ইস্টাসন ভালকো, ছব-রেজিস্ট্রারিঃ- কুমারখালি ইত্যাদি। দলিলে লালনের নিজ হস্তের দস্তখাত আছে। এখানে লালন নিজের প্রয়োজনেই তার পরিচয় ব্যক্ত করেছেন।
হরিশপুরের পূর্ব পাড়া সংলগ্ন বেলতলা গ্রামের ঝড়- মন্ডলের পুত্র দুদ্দু শাহ লালন শাহ’র প্রধান অন্তরঙ্গ ভক্ত ছিলেন। তৎকালিন যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার শৈলকুপা থানার আলমডাঙ্গা গ্রামের পরমানন্দপুর মৌজাধীন এলাকায় জমি খরিদ করে লালন শাহ’র একটি আঁখড়াবাড়ি নির্মান করেন। এ আঁখড়ার তত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন লালন শাহ’র অন্যতম শিষ্য শুকুর শাহ ফকিরের উপর। এই শুকুর শাহ’র আঁখড়াতে বসে দুদ্দু শাহ একদা এক নিরালাক্ষণে লালনের নিজ মুখে বর্ণিত আত্মবিবরণী শুনে ছিলেন, যা তিনি এক পঁথিতে তা লিপিবদ্ধ করে যান। এখানে দুদ্দু শাহের ভাষায় তা উদ্ধৃত করা হলো-
আলমডাঙ্গা গ্রামে শুকুর শাহৰ আশ্রমে
আরজি করিনু আমি অতীব নির্জনে
*************************
কহ কিছু আত্মকথা এদাসে বুঝাইয়া
এত শুনি দয়াল চাঁদ মোর পানে চায়।
মৃদু হাসি এই দাসে যাহা কিছু কয়॥
মুক্তাছার তার কিছু বর্ণনা করিব।”
ইত্যাদি।
এসময় লালন শাহ প্রধান ভক্ত দুদ্দু শাহকে যে বংশ পরিচয় দান করেছিলেন তারই ভাষায় তা উদ্ধৃতি করা হলো-
ধন্য ধন্য মহামানুষ দয়াল লালন সাঁই
পতিত জনার বন্ধু তাঁর গুন গাই।
********************
এগার-শো উন আশি কার্তিকের পহেলা
হরিশপুর গ্রামে সাঁইর আগমন হৈলা।
যশোর জেলাধিন ঝিনাইদহ কয়
উক্ত মহাকুমাধিন হরিশপুর হয়।
গোলাম কাদের হন দাদাজি তাহার
বংশ পরস্পরা বাস হরিশপুর মাঝার
দরীবুল্লা দেওয়ানজি তার আব্বাজির নাম
আমিনা খাতুন মাতা এবে প্রকাশিলাম।
***********************
বারশত সাতানববই বাংগালা সনেতে
পহেলা কর্তিক শুক্রবার দিবান্তে।
সবারে কাঁদায়ে মোর প্রাণ দয়াল
ওফাৎ পাইল মোদের করিয়া পাগল।
ফকির লালন শাহ যে হরিশপুইে জন্মগ্রহণ করেন তার আর একটি বড় প্রমান রয়েছে। হরিশপুরের পূর্বপাড়া সংলগ্ন ঠাকুরতলায় (বটবৃক্ষতলে) ধূয়োজারি গানের এক প্রতিযোগিতায় সমকালিন খ্যাতিমান লোক কবি পাগলা কানাই(১৮০৯-১৮৮৯) অংশ গ্রহণ করেন। তিনি সেই প্রতিযোগিতায় একটি ধূয়ো গানে উল্লেখ করেন-
ধুয় গানে হবে পাল্লা
মুখে সবে বর আল্লা
এই আমার যশোর জিলা
হরিণুকুণ্ডু থানাতে
গ্রামের নাম হরিশপুরী
খাটবে নাকো জারিজুরি
বহু লোকের মাতব্বরী
আসরে আইছি কথা জানাতে
হরিশপুর তার জন্ম মাটি
লালন শাহ ফকির খাঁটি
জানালাম তাও কথাটি
হাজার সালাম চরণে তাঁর
গুরু সিরাজ কাহার
সালাম জানাই তাঁহার
জসিম বিশ্বাস,নসিম বিশ্বাস
তুফান সর্দার
বেলতলার নৈমুদ্দি বিশ্বাস
কত কি বলব আর
আমি নির্গুনে কানাই
সালেম আলেকুম জানাই
ছোট-বড় দশজনের পায়
ঠাকুর তলার এই আসরে
বটবৃক্ষ স্বাক্ষী থেকো
আল্লাহ রসুল ফেলোনাকো
ইদু বিশ্বাসকে ডাক
কথা জিজ্ঞাসী ভাল করে”।
লালন গবেষক অধ্যাপক আবূ তালিব ১৯৫৩ সালের ভাদ্র সংখ্যায় মাহে-নও পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে “ সব লোকে কয়, লালন ফকীর হিন্দু কি যবন,’ গানটির উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, লালন এই গানের শেষ পঙক্তিতে নিজেকে ‘খাতনার জাত’ হিসেবে নিজের পরিচয় উন্মোচন করেছেন। তার গানের শেষ স্তবকটিতে রয়েছে-
বিবিদের নাই মুসলমানী
পৈতা যার নাই সেও বাওনী
বোঝেরে ভাই দিব্যজ্ঞানী
লালন তেমনি খাতনার জাত একখান’।
উক্ত গানটি সম্পর্কে লালন শাহ দরগা কমিটির তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক গোলাম রহমান সাহেব মনে করেন, আলোচ্য গানটিতে লালন নিজেকে মুসলমান সন্তান বলেই প্রকাশ করেছেন। কেননা খাত্না দেওয়ার প্রথা শুধু মুসলমান আর ইহুদীদের মধ্যেই বিশ্বে প্রচলিত।
ফকির লালন শাহ ১৮৯০ সালে ১৭ অক্টোবর ছেউড়িয়াস' আখড়া বাড়িতে দেহান্তরিত হলে তাকে আখড়ার মধ্যে কবরস' করা হয়।
এ সকল তথ্যাদি প্রমান করে লালন শাহ হরিশপুরে মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণকারী একজন মানবতাবাদী মহান কবি ও সাধক।্ এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।
লালন গুরু দরবেশ সিরাজ সাঁইঃ (১৭৫০- ১৮১৯)
ইতিহাস ঐতিহ্যের পাদপীঠ খ্যাত হরিশপুরে অসামান্য সাধক পুরুষ সিরাজ সাঁই ১৭৫০সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হিরাজ তুল্য। পারিবারিক পেশা পাল্কী বাহক (বেহারা সমপ্রদায়) হলেও সিরাজ সাঁই একবারে নিঃস্ব পরিবারের সন্তান ছিলেন না। বেশ কিছু জায়গা জমির মালিক ছিলেন তার পিতা। পিতার মত্যৃুর পর উত্তাধিকার সূত্রে সিরাজ সাঁই সে সম্পত্তির মালিক বনে যান।
সে সময় নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রচলন ছিল না বললেই চলে। কেউ কেউ গ্রামের মক্তবে গমন করে বাল্য কালে কিছুটা আরবী ফার্সি শিক্ষার মধ্যে তাদের বিদ্যা অর্র্জন সীমাবদ্ধ রাখত। সিরাজ সাঁই কিছুদিন মক্তবে যাতায়াতের ফলে সামান্য কিছু আরবী ফার্সির সাথে বাংলা লেখাপড়া আত্মস' করার প্রচেষ্টা চালান। তবে সে লেখাপড়া জমাজমির কাগজপত্র দেখা ও কিতাব পড়তে পারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
বাল্যকাল হতেই পৈত্রিক ব্যবসা পাল্কী বাহনের পেশায় আত্মনিয়োগ করে পিতাকে সহায়তা করার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে যাতাযাত করতে হত সিরাজকে। উনিশ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর পুরা সংসারের দায়িত্বভার সিরাজকে নিজ কাঁধে তলে নিতে বাধ্য হতে হয়। এর এক বছর পর তিনি এক সুশীল, শান্ত, মিষ্টভাষী রমনীকে বিবাহ করেন। পরবর্তী কালে এই মহিলা প্রেমময়ী নারী, স্নেহময়ী জননী, সহানুভুতিশীলা প্রতিবেশীনি রুপে এমন সুনাম অর্জন করেন যা আজও হরিশপুর অঞ্চলে কিংবদন্তী হয়ে আছে।
২৬ বছর বয়সে ছিয়াত্তরের মন্বান্তরের কবলে পড়ে সারা বাংলা জুড়ে দেখা দেয় চরম দুর্ভিক্ষ। খাদ্য সঙ্কটে দেশে কয়েক লক্ষ লোক অকাল মৃত্যু বরন করে। হরিশপুরেও এসময় অসংখ্য মানুষ অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সামাজিক অসি'তরতার কারণে সিরাজের জাত ব্যবসাও এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। পৈত্রিক ভাবে প্রাপ্ত জমিটুকু বিক্রি করে বৃদ্ধ মাতাসহ স্ত্রীকে নিয়ে কোন রকমে জীবন যাপন করতে থাকে। দুর্ভিক্ষ শেষ হতে না হতেই প্রায় সব জমিই শেষ হয়ে যায় সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহের পিছনে। তখন সিরাজের সামনে পাল্কী বাহনের পৈত্রিক পেশাই জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ হিসেবে খোলা থাকে। জীবিকা উপার্জনের জন্য পাল্কী বহন করতে তাকে দেশের বিভিন্ন এলাকাতে গমন করতে হত। এভাবে দেশ ভ্রমনকালে একদিন বিখ্যাত পীর আগর মানিক শাহজীর সাথে পরিচয় হয়। প্রচলিত আছে, একদিন সিরাজ সাঁই’র পালকীতে গমন করে পীর সাহেব এক মুরিদানের বাড়িতে পৌছান। গন্তব্যে পৌছে পীর সাহেব সিরাজকে পারিশ্রমিক দিতে চাইলে সিরাজ পারিশ্রমিক নিতে অস্বীকৃতি জানান। উপরন্ত বলেন, পীরের পায়রবী করতে পারলেই জীবন ধন্য হবে। এঘটনায় পীর সাহেব সিরাজের বিনয় ও ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে আশীষবানী দানে ধন্য করেন। সিরাজ সাঁই তখন পীরের নিকট মুরিদ হওয়ার অকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। এক মুরিদের বাড়িতে বসে আগর মানিক শাহজী সিরাজ সাইকে মুরিদ রুপে গ্রহণ করেন।
মুরিদ হয়ে তিনি পীরের নিকট থেকে এলমে তাসাউফের সবক নেওয়ার পাশপাশি উচু স্তরের অমলের দিকে ঝুকে পড়েন। সুফি মতবাদ ও দরবেশী ভাবধারা এসময় তার অন্তরে গুপ্ত ভান্ডারের মত দানা বেঁধে ওঠে। কিন' প্রকাশ্যে তিনি সিরাজ বেহারা রুপেই পরিচিত হতে থাকেন। নৈমুদ্দীন নামে তার একটি পুত্র সন্তান ছিল। বংশ পরম্পরায় সিরাজ সাঁই বংশধরেরা আজ অবধি হরিশপুর পশ্চিম পাড়ায় দীনহীন পরিবেশে জীবন যাপন করছে।
ইতিহাসেরর পথক্রমায় মহান সাধক ফকির লালন শাহ’র দীক্ষা গুরু হিসেবে পরিচিতি লাভের পর তিনি ইতিহাস খ্যাত হয়ে ওঠেন। এই মহান সাধক ১৮১৯ সালে ইন্তেকাল করেন। নিজ বাড়ির আঙিনায় তাকে সমাহিত করা হয়। বর্তানে দরবেশ সিরাজ সাঁই’র মাজার সংলগ্ন এলাকাতে লালন একাডেমী মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। মাজার চত্বর ও পার্শ্ববর্তী এলাকাতে এখন প্রতি বছর লালন স্মরনোৎসবের আয়োজন করা হয়।
লালন শাহ’র প্রধান ভক্ত সাধক কবি দুদ্দু শাহ (১৮৪১-১৯১৯)
মরমী সাধক ফকির লালন শাহ’র প্রধান ভ্ক্ত হিসেবে দুদ্দু শাহ’র একটি বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। লালন জন্মভূমি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হরিশপুর পূর্ব পাড়া সংলগ্ন ছোট্র একটি গ্রাম বেলতলা। এ গ্রামের অবস'া সম্পন্ন কৃষক ঝড়- মন্ডলের ছেলে দবির উদ্দিন ওরফে দুদ্দু শাহ ১৮৪১ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। ঝড়- মন্ডলের চার ছেলে তারা হলেন- মধু মন্ডল, পিরু মন্ডল, গরাই মন্ডল এবং দবির উদ্দিন ( দুদ্দু শাহ)। চার ভায়ের মধ্যে দুদ্দু শাহ ছিলেন সকলের ছোট। ফকিরি মতে দীক্ষা গ্রহনের পর তিনি দুদ্দু শাহ নাম ধারণ করেন। অবস'া সম্পন্ন গৃহস' পরিবারের সন্তান দুদ্দ শাহ ভাইদের মধ্যে সকলের ছোট হওয়ায় বড় ভায়েরা সংসারের প্রয়োজনে জীবিকা উপার্জনে নিয়োজিত ছিলেন। কিন' তাদের অনুজ প্রতিম দুদ্দুকে সংসারের কোন দায়ভার টানতে দেননি।
বাল্যকালে দুদ্দু হরিশপুরর শ্রীনাথ বিশ্বাসের পাঠশালায় বিদ্যা শিক্ষার সুযোগ অর্জন করেন। তৎকালিন সময়ে এলাকাতে শ্রীনাথ বিশ্বাসের পাঠশালার বিশেষ খ্যাতি ছিল। আশৈশব অসম্ভব মেধাবী দুদ্দু পাঠশালার কোন পাঠ একবার শ্রবণ করলে সঙ্গে সঙ্গে তা আত্মস' করে ফেলতে পারতেন। তার এই প্রখর স্মৃতি শক্তির কারণে শিক্ষকরগন মুগ্ধ হয়ে বালক দুদ্দুকে বিশেষ স্নেহ করতেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি পাঠশালার পাঠ সফল ভাবে সমাপ্ত করেন। শিক্ষা দীক্ষায় অনগ্রসরতা কারণে তৎকালিন সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল কলেজের প্রাচুর্যতা ছিল না। এ কারণে পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করে বাড়িতে স'ানীয় আলেমদের নিকট তিনি আরবী ফার্সি শিক্ষা লাভ করেন। এসময় তিনি নিজ প্রচেষ্টায় সমগ্র কুরআন কণ্ঠস' করে হাফেজ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন বলে প্রচলিত আছে।
সমসাময়িক কালে হরিশপুরে মদন দাস গোস্বামী নামে একজন পন্ডিত ব্যক্তি বাস করতেন। সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত মদন দাস গোস্বামীর নিকট প্রখর মেধাবী দুদ্দু শাহ সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা লাভের মাধ্যমে নিজের নৈপূন্যতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হন। প্রচলিত আছে শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত তার কণ্ঠস' ছিল।
শিক্ষা জীবন শেষে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ভাইদের বদ্যনতায় দুদ্দু সংসারের কায়িক পরিশ্রমের পরিবর্তে জমাজমি তদারকি, খাজনা পত্র আদান প্রদান করে অবশিষ্ট সময় জ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়োগ করতেন।
এসময় হরিশপুরে বহু সাধু-সন্যাসী, আউলিয়া দরবেশের বসবাস ছিল। দুদ্দু তাদের কারও কারও সংস্পর্শে এসে সুফিবাদের প্রভাবে ভাববাদী হয়ে ওঠেন। তিনি প্রায়ই হরিশপুস' সাধক দরবেশদের সাথে আধ্যাত্মিক আলাচনায় মত্ত হয়ে সময় অতিবাহিত করতেন। এসময় থেকেই তিনি জীবন পথের সঠিক দিশা অনুসন্ধানের জন্য উপযুক্ত মুরশিদের সন্ধান করতে থাকেন।
ত্রিশ বছর বয়সে তিনি দেশ ভ্রমণে বের হয়ে পড়েন। যশোর, নবদ্বীপ ও নদীয়া জেলার বিভিন্ন স'ান ভ্রমন শেষে তিনি কুস্টিয়া এসে উপনীত হন। উপযুক্ত গুরু সন্ধানের এক মহেন্দ্র ক্ষণে মহামতি ফকির লালনের সাথে তার সাক্ষাত ঘটে। সাধক ও ভাব সঙ্গীতের স্রষ্ট্রা হিসেবে লালনের তখন চারিদিকে ব্যাপক পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে। ছেউড়িয়া আখড়া বাড়িতে বসে দুদ্দু শাহ ফকির লালনের সাথে ধর্মলোচনায় লিপ্ত হন। লালনের অসম্ভব প্রতিভা তাকে মুগ্ধ করে। নিজের অজান্তে হৃদয়ে তিনি লালনকেই গুরুপদে স'ান দান করেন। প্রচলিত আছে লালনের সাথে দুদ্দুর রীতিমত ধর্মীয় বাহাছ হয়। বাহছে লালনের পান্ডত্যের নিকট দুদ্দু পরাজয় বরণ করেন। পরাজয়ের পর তিনি ফকির লালনের হাতে বায়াত হয়ে মুরিদ হওয়ায় অভিলাষ ব্যক্ত করেন। লালন শাহ নিজ হস্তে দুদ্দু শাহকে মুরিদ করে শিষ্যত্ব প্রদানের মাধ্যমে ধন্য করেন। এ বিষয়ে দুদ্দু শাহ তার নিজ জবানীতে উল্লেখ করেন এভাবে-
“বাহাছ করিতে এসে বয়াত হইনু
আমি অতি অভাজন লালন সাই বিনু”।
এরপর থেকে দুদ্দু শাহ নিজ পীরের খেদমতের পাশপাশি জ্ঞান সাধনায় লিপ্ত হয়ে ছেউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে কালকাটাতে থাকেন। দুদ্দু শ্াহ ফকির লালনের একান্তে সান্নিধ্যে অল্প কিছুদিন অতিবাহিত করতে না করতেই নিজের জ্ঞান এবং কর্ম দক্ষতার গুনে গুরুর বিশেষ প্রিয় ভাজন মুরিদ রুপে স্বীকৃত লাভ করেন। এসময় থেকে গুরু প্রতিভার সংস্পর্শে তার সুপ্ত প্রতিভাও পরিপূর্ণ রুপে বিকশিত হয়ে ওঠে। ফকির লালন তার অন্যান্য শিষ্যদেরকে দুদ্দুকে নিজের পিতার সম-মর্যদার আসন দান করে তাদেরকে দাদা বলে ডাকতে নির্দেশ দিতেন। দুদ্দু শাহ গুরু ফকির লালনের মত নিজেও ভাব সঙ্গীত রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন' স্বল্প সময়ের ব্যবধানে লালন অবগত হন-তার প্রিয় মুরিদ ঘোর সংসারী। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর পরই তিনি দুদ্দুকে নিজ পরিবারের নিকট ফিরে যাবার নির্দেশ দান করেন। গুরুর নির্দেশ শিরোঃধার্য মান্য করে তিনি নিজ জ্ন্মস'ান বেলতলা ফিরে এসে পরিবার পরিজনের সাথে সংসার জীবন শুরু করেন।
এসময় হরিশপুরের আর এক সাধক প্রবর পাঞ্জু শাহ’র সাথে দুদ্দু শাহ’র পরিচয় ঘটে। উভয়ের মধ্যে সৃষ্টি হয় হৃদ্রতা পূর্ন সম্পর্ক। বয়সে তিনি পাঞ্জু শাহ অপেক্ষা কিছুটা বড় ছিলেন। ভাবগীতির স্রস্ট্রা এবং চিশতিয়া খান্দানীর ফকির হিসেবে উভয়ের মধ্যে গভীর সদ্ভাব পরিলক্ষিত হয়। দুদ্দু শাহ প্রায়ই পাঞ্জু শাহ’র হরিশপুরস' আঁখড়াতে সময় কাটাতেন। এখানে উভয়ে কুরআন হাদিস ও এলমে মারেফতের তত্ত্ব আলোচনায় মশগুল থাকতেন। দুদ্দু শাহ নিজ গ্রাম বেলতলাতে অবস'ান কালে মাঝে মধ্যে তার গুরু লালন শাহ প্রিয় ভক্তের বাড়িতে আগমন করতেন। এসময় লালন শাহ ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করতেন বলে তৎকালিন সময়ে স'ানীয় প্রবীণ ব্যক্তিগন তথ্য প্রদান করেন।
হরিশপুরের বাসিন্দা প্রবীণ ব্যক্তি মুন্সি আব্দুল আজিজ বরেন-“ বেলতলা দুদ্দু শাহ’র বাড়িতে লালন শাহ’র আগমন ঘটেছে শুনে, আমরা কয়েকজন লালনকে দেখতে গেলাম। সেখানে যেয়ে দেখলাম লালন সভা মধ্যে দণ্ডায়মান। আমার বয়স তখন অল্প হলেও সে স্মৃতি আমার এখনো মনে আছে”।
বৃদ্ধ বয়সে দুদ্দু শাহ খেলাফত (খেরকা) গ্রহণ করেন। ফলে সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব স্বজনদের উপর ন্যস্ত করে তিনি সৃষ্ট্রার সন্তোষ্টি লাভের সাধনা এবং আধ্যাত্মিক ভাব সঙ্গীত রচনায় পরিপূর্ণ রুপে আত্মনিয়োগ করেন। তার রচিত লালন চরিত ও নূরে মোহাম্মদী নামক দুখানি পুঁথি সাহিত্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি অত্যন্ত উচু মানের রচনা শৈলী সমৃদ্ধ সঙ্গীত রচনা করতেন। তার রচিত সঙ্গীতের সংখ্য তিন শাতাধিক বলে জানা যায।
সামপ্রতিক সময়ে দুদ্দু শাহ’র জীবন ও কর্মের উপর গবেষনার ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করছে। তার কর্মময় জীবন ও কাব্য নিযে এক ডজনের বেশি গ্রন' দেশ বিদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। স্বভাব কবি দুদ্দু শাহ শেষ জীবনে দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে পড়েন। অন্ধত্বও তার সঙ্গীত চর্চা বন্ধ করতে পারেনি।
১৯১৯ সালে এই সাধক কবি নিজ বাড়ি বেলতলাতে দেহান্তরিত হন। বাড়ির আঙ্গিনায় তাকে সমাধিস' করা হয়। সমাধি পরিদর্শনের জন্য দেশ বিদেশের গবেষক-পর্যটকগন নিভৃত পল্লী বেলতলায় গমন করে থাকেন।
সাধক কবি পাঞ্জু শাহ( ১৮৫১-১৯১৪)
মরমী সাহিত্য ধারায় ফকির লালন শাহ’র অত্যন্ত প্রিয় ভাজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন কবি পাঞ্জু শাহ। লালন পররবর্তী কবিগনের মধ্যে পাঞ্জু শাহ’র নাম বিশেষ ভাবে স্মরনীয়। লালন শাহ’র আশীষবানী এবং স্বীকৃতি পাঞ্জু শাহকে সাধক সমাজে বিশেষ ভাবে পরিচিত করে তোলে। এ পিরিচিতি তৎকালিন সময়ে তাকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত দেশের সাধক মন্ডলীর পরিচালক রুপে নিয়োজিত থাকার সুযোগ লাভে সহায়তা করে। এ বিষয়ে খোন্দকার রফি উদ্দিনের অভিমত বিশেষভাবে লক্ষনীয়ঃ তিনি বলেন-“বাংলার সুফি ফকিরের মধ্যে লালনের স'ান সর্বোচ্চে। কিন' লালনের তিরোধানের পর যিনি সারা বাংলার ফকির মহলে লালনের শূন্যস'ান পূরণ করে রেখেছিলেন, অসাধারণ প্রতিভাধর লালন শাহের তিরোভাব জনিত শূন্যতা পূরণের ক্ষমতা নিয়ে জন্মে ছিলেন পাঞ্জুু শাহ।” এ কথাটি চিন্তা করলে পাঞ্জু প্রতিভা সম্পর্কে আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ থাকে না। বস'ত পাঞ্জু শাহ যথার্থ পূর্বসূরির মর্যদা উপলদ্ধি করতে পেরে ছিলেন। সে জন্য তিনিও লালনের ভাবশিষ্য হয়েই কাব্য চর্চায় আত্ম নিয়োগ করেন। ফলে সমকালিন বাংলাদেশে পাঞ্জুর কবি খ্যাতি ও মরমী ভাব সাধনা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। তাই দেখা যায় ফকির লালনের অত্যন্ত বয়ঃকনিষ্ঠ সমসাময়িক এই সাধক একটি স্বতন্ত্র ঘরনা ও বিশেষ কাব্য সঙ্গীত গোষ্ঠির উদ্যোক্তা হিসেবে উনিশ শতকের শেষার্ধে এবং বিশ শতকের প্রথমার্ধে এদেশের সাহিত্য সাংস্কতিক অঙ্গনে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ক্ষেত্র বিরাজমান। এসব দিক পর্যালোচনা করলে পাঞ্জু শাহ’র জীবন ইতিহাস বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
কবি পাঞ্জু শাহ ১২৫৮ বঙ্গাব্দে (১৮৫১ খ্রিঃ) ২৮শে শ্রাবণ ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। এসময় কবি পিতা খোন্দকার খাদেম আলী এবং মাতা জোহরা বেগম শৈলকূপাস' নিজেদের জমিদার ভবনে বসবাস করতেন। খোন্দকার খাদেম আলী ছিলেন পাঁচ সন্তানের জনক। তার সন্তনগন হলেন যথাক্রমে শাহারণ নেছা, তহিরণ নেছা, খোন্দকার পাঞ্জু, খোন্দকার ওয়াসিম উদ্দিন ও আইমানী নেছা। পাঞ্জু শাহ পিতামাতার তৃতীয় সন্তান ছিলেন।
খোন্দকার খাদেম আলী যখন শৈলকূপা ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী উপজেলার হরিশপুর অভিমুখে যাত্রা করেন তখন তার জ্যেষ্ঠ কন্য শ্বশুরালয়ে, মেজে কন্যা পরলোকে এবং কনিষ্ঠ কন্যার জন্ম হয়নি। সুতারং ভাগ্য বিড়ম্বিত এই অমানিশায় বালক পাঞ্জু এবং শিশু ওয়াসিম পিতার সহযাত্রী হিসেবে হরিশপুর গমন করেন। হরিশপুর আগমনের পর কনিষ্ঠ কন্যা আয়মানীর জন্ম হয়।
পাঞ্জু শাহ’র জীবন প্রকৃত পক্ষে হরিশপুর থেকেই শুরু।“ বসতি মোকাম মেরা হরিশপুর গ্রাম” একথা কবি তার নিজ লেখনীতে উপস'াপন করেন। বস'ত বিলাসী জমিদার নন্দন রুপে নন, কঠোর সংগ্রামী মোল্লার সন্তান রুপেই তিনি বেড়ে উঠতে থাকেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোন বিদ্যালয়ে তার লেখা পড়ার সুযোগ হয়নি। বাড়িতে উস্তাদের নিকট আরবী ফার্সী শিক্ষার মধ্য দিয়েই তার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়।
পাঞ্জু শাহ’র পিতা একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন্। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি ছিল তার অসম্ভব শ্রদ্ধাবোধ। খোন্দকার রফি উদ্দীন বলেন-ফকির পাঞ্জু শাহ’র পিতা একজন গোঁড়া মুসলমান ছিলেন। শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়ায় তিনি সন্তানকে বাংলা ভায়ায় শিক্ষা দানের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। পিতার অনাগ্রহের কারনে বালক পাঞ্জু ছোট বেলায় আরবী ফার্সী ছাড়া বাংলা ইংরেজি শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। কিন' বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তিনি উপলদ্ধি করেন যে, মাতৃভাষা ভালভাবে আয়ত্ত্ব করতে না পারলে আত্ম চিন্তা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। ফলে তিনি ষোল বছর বয়সে হরিশপুর নিবাসী মহর আলী বিশ্বাসের নিকট বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ শুরু করে সফলতা লাভ করেন।
এখানেই পাঞ্জুর অনিয়মিত ছাত্র জীবনের সমাপ্তি ঘটে। বৃদ্ধ পিতাকে সাহায্য করার তাগিদে বেশ খানিকটা সংসারের দায়িত্ব তার কাঁধে চেপে বসে। এভাবে সংসার জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। চব্বিশ বছর বয়সে পাঞ্জু চুয়াডাঙ্গা জেলার আইলহাস- লক্ষীপুর গ্রামের খোন্দকার আব্দুর রহমানের কন্যা ছন্দন নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই পূন্যবতী-গুনবতী জীবন সঙ্গীনি পাঞ্জু শাহ’র সাধক জীবনকে বিভিন্ন ভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। বিবাহের দুই বছর পর তাদের প্রথম সন্তান শামস্ উদ্দিন জন্ম গ্রহণ করে। পরবর্তী কয়েক বছরের ব্যবধানে কলিমন নেছা ও ছালেহা খাতুন নামে দুই কন্যা সন্তান জন্ম লাভ করে।
সাতাশ বছর বয়সে পাঞ্জু শাহ’র পিতৃ বিযোগ ঘটে। সঙ্গত কারনেই তখন সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়। কর্তব্য পরায়ন পাঞ্জু এ গুরুভার বহনে কখনো পিছপা হননি। পরিবারের সকলের সুবিধা অসুবিধার প্রতি তিনি তীক্ষ্ম নজর রাখতেন। এসময় পৈত্রিক বসত ভিটা কনিষ্ঠ ভ্রাতা খোন্দকার ওয়াসিম উদ্দিনকে ছেড়ে দিয়ে সাত বিঘা জমি খরিদ করে সেখানে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেন। এছাড়া আরো পঁচিশ বিঘা মাঠান জমি ক্রয় করে সংসারে সচ্ছলতা আনায়নে বিশেষ ভূমিকার রাখেন। কৈশর থেকেই পাঞ্জু শাহ মরমীবাদের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। কিন' পিতার অনাগ্রহের কারণে তার জীবিত অবস'ায় পা্রকাশ্য ভাবে কোন ফকিরি মজলিসে তিনি যেতে পারতেন না। পিতার পরলোক গমনের পর তিনি ফকিরি মজলিসে অবাধে যাতায়াত শুরু করেন্ ।
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে পাঞ্জু শাহ খেরকা গ্রহনের মাধ্যমে পুরাপুরি ফকিরি মতবাদে দীক্ষিত হন। এসময় থেকেই তার সাধক জীবনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। একটি আধ্যাত্ম চেতনা লাভ করে তিনি সাধনার উচ্চমার্গে আরোহন করেন। খোন্দকার হিরাজ তুল্লাহ নামে জনৈক তত্ত্ব সাধকের নিকট তিনি দীক্ষা গ্রহণ করেন।
পাঞ্জু শাহ ধুয়োজারি, ভাব সঙ্গীত এবং হিন্দু মুসলমানদের আধ্যত্ম সাধনা দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি সাধক হিরাজতুল্লার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সুফি ভাবধারায় গান রচনা শুরু করেন। তার রচিত মরমী গানের সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। গানগুলি বাউল তত্ব দ্বারা প্রভাবিত। এসকল গান তার শিষ্যগন মুখে মুখে গেয়ে সমাজে প্রচার করতেন। তার পুত্র খোন্দকার রফি উদ্দীন রচিত ভাব সঙ্গীত গ্রনে' বেশ কিছু গান সঙ্কলন করেন। এছাড়া ড. খোন্দকার রিয়াজূল হকের মরমী কবি পাঞ্জু শাহ; জীবন ও কাব্য গ্রনে' তার রচিত দুই শতাধিক গান প্রকাশ করেন।
পাঞ্জু শাহ তার কবিতা ও গানে মানবতার জয়গান করেছেন। একটি গানে তিনি বলেন- ‘মানুষের করণ মানুষ ভিন্ন নয় ওরে মন’। ১৮৯০ সালে ছহি ইস্কি ছাদেকী গহোর নামে তার একখানা কাব্য গ্রন' প্রকাশিত হয়। এখানে সুফি তত্ত্বের মর্মকথা ও নৈতিক উপদেশ বর্ণিত হয়েছে।
সমাজ জীবনেও পাঞ্জু শাহ অত্যন্ত অমায়িক ও জনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সমাজের গুনি ব্যক্তিদের তিনি যথেষ্ট কদর করতেন। গুনিদের সাথে তিনি দরবারে বসতেন এবং সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের পরামর্শ চাইতেন। অতিথি পরায়নতা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য। কোন আবেদনকারী সায়েলকে তিনি শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। এতিম, বিধবা, অসহায় দুস'্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সর্বদাই তার অনুকম্পা পেয়ে থাকতেন।
আখঁড়া তত্ত্বাবধানের জন্য এসময় আরো একজন জীবন সঙ্গীনীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কুস্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার বড়-লিয়া নিবাসী অফিল উদ্দিনের কন্যা পাচি নেছাকে ২য় স্ত্রী হিসেবে বিবাহ করেন। উভয় স্ত্রীর মাঝে তিনি বৈষম্যহীন অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এক অনন্য নজীর স'াপন করেন। তিনি প্রথম স্ত্রীকে আদর করে রজনী এবং ২য় স্ত্রীকে প্রেয়সী বলে সম্বধন করতেন।
পাচি নেছার গর্ভে তিন পুত্র এবং এক কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। তারা হলোঃ খোন্দকার শফি উদ্দিন জয়তুন নেছা, খোন্দকার রফি উদ্দিন এবং খোন্দকার রইছ উদ্দিন। ব্যক্তি জীবনে পাঞ্জু শাহ ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিদে বিলাসহীন মানুষ। সাধারন ডাল ভাত খেযেই তিনি দিনপাত করতেন। তিনি নিজে মাছ মাংস না খেলেও শিষ্যদের মাছ মাংস বর্জনের বিষয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি।
১৯১৪ সালে তিনি হরিশপুর আখড়াতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পূর্ব পশ্চিম মুখি করে তাকে নিজ গৃহে সমাধিস'' করা হয়। দুই পাশে তার দুই স্ত্রীকে সমাহিত করা হয়। এখানে বছরে একাধিক সময়ে স্মরনোৎস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ সকল অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তবৃন্দ উপসি'ত হয়ে থাকে।
জনকল্যানের মূর্ত প্রতীক ফকির মাহমুদ বিশ্বাসঃ( ১৮১৬-১৮৯৩)
ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু থানার অন্তর্গত রঘুনাথপুর ইউনিয়নের কালাপাহাড়িয়া গ্রামে ১৮১৬ সালে ফকির মাহমুদ বিশ্বাস জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা আদম আলী বিশ্বাস ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক। পিতার দরিদ্রতার কারণে দুঃখ কষ্টে কাটে ফকির মাহমুদের শৈশব কাল। বৈবাহিক সূত্রে ফকির মাহমুদ একজন অবস'া সম্পন্নন কৃষকে পরিণত হন। অনেক জমাজমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি অতি সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করতেন। কায়িক পরিশ্রম প্রিয়তা ছিল তার জীবনের ভূষণ। মাঠে মাঠে অবলীলায় গরু ছাগল চরিয়ে বেড়াতে দ্বিধাবোধ করতেন না। সুফি সাধনার ফলে তার হৃদয়ে উন্নত মানসিকতার বিকাশ ঘটে। তিনি একজন খাটি নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন্
বাল্যকাল অতি কষ্টের মধ্যে অতিবাহিত হলেও সচেতন কৃষক পিতার আন্তরিকতায় ফকির মাহমুদ মক্তবে গমন করে ফার্সি ভাষায অনেকখানি জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। বাল্যকালের এ শিক্ষাাই তার পরিণত বয়সের ধর্মীয় সদাচারন রপ্তে বহুলাংশে সহায়ক হয়ে ওঠে। জন্মস'ান কালাপাহাড়িয়া গ্রামের পশ্চিম পাশে
নটাবিল নামক একটি প্রসিদ্ধ বিল আছে। কিশোর বয়সে তিনি এ বিলের ধারেই অধিকাংশ সময় গরু
ছাগল চরানোর পাশাপাশি পিতাকে কৃষি কাজে সহায়তা করতেন। তৎকালে নটাবিল হতে জলস্রোত দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে হরিণাকুণ্ডুর কুমোর রাজা খ্যাত রাজা হরিষচন্দ্র পাল কর্তৃক খননকৃত কুমরাইল নামক নদীতে পতিত হত। এমন পরিবেশে সাধারণ রাখাল বেশে নিজ গ্রামে তার বাল্যকাল কাটে।
কুলবাড়িয়া গ্রামের দক্ষিণ পার্শ্বস' বলরামপুর গ্রামের জোর্য়াদার পরিবার একটি সুপরিচিত গোষ্ঠি। এ পরিবারে ভাদু জোয়ার্দার ও সাদু জোয়ার্দার নামে দুই অবস'া সম্পন্ন কৃষক ভ্রাতা বসবাস করতেন। তাদের তিন হাজার বিঘার অধিক সম্পত্তি ছিল বলে জানা যায়। ভাদু জোয়ার্দারের একমাত্র বিদূষী কন্যাকে সম্ভ্রান্ত পরিবারে উপযুক্ত পাত্রের সাথে বিবাহ দেওয়ার জন্য মনসি'র করেন। কিন' কোথাও তেমন উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান মিলাতে পারেন না পিতা।্ অবশেষে পাশের গ্রামের তরুন ফকির মাহমুদের উপর ্কন্যা পক্ষের নজর পড়ে। ভাদু জোয়ার্দারের একমাত্র কন্যার সাথে এক শুভক্ষনে ফকির মাহমুদ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহ সূত্রে তিনি বিপুল সম্পত্তির মালিক হন। বিবাহের পর শ্বশুরের অনুরোধে বেশ কয়েক বছর তিনি পিতামাতাসহ শ্বশুরালয়ে বসবাস করতে থাকেন। তার দুই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শ্বশুর বাড়ির পার্শ্ববর্তী কুলবাড়িয়া গ্রামের উত্তরাংশে নিজেদের জমিতে বাড়ি নির্মান করে স'ায়ী ভাবে বসবাস শুূরু করেন। বর্তমানে তার বাড়িটিতে মাজার, মসজিদ ও এতিমখানা অবসি'ত। তিনি ছিলেন অতিথি পরায়ন ও দানশীল ব্যক্তি। সব শ্রেণি পেশার মানুষের বিপদে অপদে তিনি নিদানের ঢাল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিজ বাড়িতে ফলের বাগান ও পুকুর খনন করে জনসেবা করতে থাকেন। এছাড়া কুলবাড়িয়া গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে ৭/৮ বিঘা জমিতে আর একটি বিশাল বাগান তৈরী করেন। যেখানে এখন কুলবাড়িয়া কেন্দ্রীয় ঈদগাহ এবং মসজিদ অবসি'ত। ঐতিহাসিক ঈদগাহটির দৈর্ঘ্য-৩৯ ফুট, প্রস' সোয়া ৩ ফুট এবং উচ্চতা ৩৭ ফুট। এরূপ ঈদগাহ দেশের ইতিহাসে বিরল। প্রাচীন কালে কুলবাড়িয়াসহ পার্শ্ববর্তী কয়েক গ্রামের লোকেরা এখানে ঈদের নামাজ আদায় করত।
এছাড়া নিজ হাতে কৃষিকাজ করে প্রচুর ফসল ফলাতেন। কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি আজীবন মানব সেবা করে গেছেন। তার জীবনীতে অনেক অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে।
একবার বারজন মহিষ গাড়োয়ান দক্ষিণ দেশে ধান তুলতে যাচ্ছিলেন। কুলবেড়ে মাঠে পৌছে তারা লক লকে মটর ক্ষেতে মহিষ লাগিয়ে দেয়। এসময় একজন গাড়োয়ান আফসোস করে বলে-“আহারে! কত ভাল শাক, রুই মাছ দিয়ে এ শাক রান্না করে ভাত খেতে পারলে হত”। ফকির মাহমুদ উচু ক্ষেতের অপর প্রান্তে বসে গাড়োয়ানের সব কথা শুনতে পান। লোকজনের মাধ্যমে গাড়োয়ানদের নিজ বাড়িতে ডেকে এনে, পুকুর থেকে রুই মাছ এবং ক্ষেত থেকে মটর শাক তুলে রান্না করে তাদের খেতে দেন। পরের ক্ষেত পশু দিয়ে খাওয়ানো চরম অন্যায়, একথা তাদের বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বলেন। লজ্জিত গাড়োয়ানগন নিজেদের অপরাধের জন্য বার বার ক্ষমা প্রার্থণা করে বিদায় নেন।
ফকির মাহমুদ বিশ্বাসের দানশীলতার আরো একটি বিশেষ ঘটনা লোকে মুখে এখনও প্রচারিত। কুলবাড়িযা গ্রামে দক্ষিণ পূর্ব দিকে বলরামপুর মৌজায় তার একটি বিশাল বাগান ছিল। এই বাগানে প্রতিবছর চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য মাসে তিনি জলছত্র বসাতেন। দুপুর বেলা পথিকদেরকে তিনি ভিজানো ছোলা ও আখের গুড় সহযোগে পানি পান করাতেন। এটি তিনি আমৃত্যু জারি রেখে ছিলেন। এখন এটি বিশ্বাসের বাগান নামে পরিচিত। এ রকম অনেক ঘটনায় ভরপুর ছিল এই মহান সাধক ব্যক্তির জীবন।
ফকির মাহমুদ বিশ্বাসের চারপুত্র সন্তাণ ছিল। তার কোন ওয়ারিশ বর্তমানে কুলবাড়িয়াতে বসবাস না করলেও পার্শ্ববতী শীতলীসহ অন্যান্য স'ানে বসবাস করেন বলে জানা যায়।
এই মহান সাধক কোনদিন পোষাকী দরবেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেননি। দরবেশী জীবন আড়াল করে সাধারণ মানুষের মত জীবন অতিবাহিত করে ১৮৯৩ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। নিজ বাড়ির আঙিনায় তাকে সমাহিত করা হয়।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক বিপ্লবী বাঘা যতীনঃ (১৮৮০-১৯১৫)
বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে যশোর একটি ঐতিহাসিক স'ান লাভ করে আছে। এদেশের বিপ্ল্লবীদের ইতিহাসে বৃহত্তর যশোরের ঝিনাইদহ মহকুমার হরিণাকুন্ডু থানার বিপ্লবী বাঘা যতীনের নাম বিশেষ ভাবে স্মরনীয়। বাঘা যতীনের পূর্ন নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। পিতা উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতা শরৎ শশী দেবী দম্পতির কোল জুড়ে বিপ্লবী বাঘা যতীন ১৮৮০ সালের ৭ ডিসেম্বর হরিণাকুন্ডু থানার রিশখালি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
শৈশবের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় এখানে অতিবাহিত হয়। বড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নবগঙ্গা নদীতে দুরন্ত সাহসিকতার সাথে সাঁতার কাটায় তিনি শৈশবেই বেশ পারদশী হয়ে উঠেন। খেলাধুলায় সাথীদের সাথে তিনি নিয়মিত শরীর চর্চা করতেন। শারীরিক শক্তির জন্য তিনি বিশেষ ভাবে খ্যাতিমান ছিলেন। কৈশরের পথ পাড়ি দিতে না দিতেই তার পিতৃবিয়োগ ঘটে। তারপর বিধবা মা শরৎ শশী দেবী কন্যা বিনোদ বালা ও পুত্র যতীনকে সঙ্গে তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালি থানার কয়া গ্রামে পিত্রালয়ে চলে যান। যতীন্দ্রনাথের মা শরৎ শশীদেবী ছিলেন স্বভাব কবি।
যতীনের প্রাথমিক শিক্ষা হাতে খড়ি শুরু হয় মাতুলালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি কৃষ্ণনগরে বড় মামা বসন্ত কুমার চট্রোাপাধ্যয়ের বাসায় থেকে পরবর্তী শিক্ষা জীবন অব্যাহত রাখেন। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণনগর এ.ডি হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রাস পাশ করেন। পরে যতীন চলে এলেন মেজো মামা ডা. হেমন্ত কুমার চট্রোপাধ্যয়ের কলকাতার বাসায়। এখানকার সেন্ট্রাল কলেজে এফ.এ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও ডিগ্রি অর্জন করা আর সম্ভব হয়নি। এসময় তিনি সর্টহ্যান্ড-টাইপ রাইটিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পড়াশোনার ইতি টেনে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন। প্রথমে স্টেনোগ্রা্রফার হিসেবে আমন টি কোম্পানিতে, পরে মুজাফফরপুরে ব্যারিষ্টার ও ত্রিহুত কুরিয়ার পত্রিকার সম্পাদক মিঃ কেনেডির অধীনে চাকরী করেন। কিন' এখানে তার মন না টিকায় কিছু দিনের ব্যবধানে পূনরায় তিনি কলকাতায় ফিরে এসে ইন্দুবালা নামে এক রমনীর সাথে পরিনয় সূত্রে আব্ধ হন।
১৯০৩্ সালে তিনি বাংলা সরকারের চীফ সেক্রেটারী মি.হুইলারের স্টেনোগ্রাফার হিসেবে সরকারি চাকুরীতে যোগদান করেন। ছোট লাটের খাস সচিবের অফিসে চাকুরি হবার কারনে কর্মপোলক্ষে তাকে শীত ও বর্ষাকালে কলকাতায় এবং বসন্ত ও গ্রীষ্মে দার্জলিং থাকতে হতো। এসময় তিনি বিপ্ল্লবীদের সাথে পরিচিত হয়ে তাদের পরিচালিত আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন। এভাবেই তিনি খোদ বৃটিশ সরকারের ছত্রছায়ায় থেকে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ছাত্র অবস'ায় তিনি উপলদ্ধি করেন, ছোট মামা ব্যারিষ্টার নিমাই চট্টোপাধ্যায় নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর ’আজাদহিন্দ’ ফৌজের সদস্য ছিলেন। তখন থেকেই দেশপ্রেমিক ্ও স্বাধীনচেতা যতীন বিপ্লবীদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন। পরবর্তীতে তিনি কর্ম জীবনে বিপ্লবী ঋষি অরবিন্দ, যতীন ব্যার্নাজী, রাসবিহারী বসু প্রমুখের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে ইংরেজ সরকার তাকে গ্রেফতার করে। বিচারে তার এক বছরের সাজা প্রদান করা হয়। সেই সাথে চাকুরী থেকে বরখস্ত করা হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ঝিনাইদহে ফিরে এসে ঠিকাদারী ব্যবসা শুরু করেন। এসময় তিনি বর্তমান ঝিনাইদহ কেসি কলেজের উত্তর পাশের একটি বাড়িতে বসবাস করতেন। এখান থেকেই তিনি যশোর, নদীয়া ও ফরিদপুরের বিভিন্ন স'াপনার ঠিকাদার হিসেবে কাজ পরিচালনা করতেন। তার ঠিকাদারিত্বেই যশোর কালেক্টারেট ভবন এবং ঝিনাইদহ ক্যাসেল ব্রীজ এর মত ঐতিহাসিক স'াপনা নির্মান করা হয়। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে প্রায়ই তাকে যশোর, নদীয়া এবং ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতে হতো। এ সুযোগে তিনি সংগোপনে ইংরেজ বিরোধী একটি বিপ্লবী দল গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। ঝিনাইদহের কালিগঞ্জের নলডাঙ্গার পাশে বলরামপুরে বিপ্ল্ল্লবের কেন্দ্র স'াপন করা হয়। তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে বিপ্ল্লবীদের সংগঠিত করে নিজ দলের তৎপরতা জোরদার করতে থাকেন। বহু তরুণ-যুবক দেশ প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে তার আদর্শের সাথে একাত্মতা প্রকাশের মাধ্যমে দলে যোগদান করে কৃতিত্বের সাথে বৃটিশ বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। নিকুঞ্জবিহারী প্রনীত ’বাংলার সেরা বিপ্ল্লবী’ গ্রনে' স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যতীনদ্রনাথ মুখোপাধ্যাযের মাতুল পরিবারের গভীর ঘনিষ্ঠতার কথা উল্লেখ আছে। যতীনের যোগাযোগ ছিল বিপ্ল্ল্লবের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ বর্তমানে খুলনার বি.এল কলেজের সাথেও।
যতীন্দ্রনাথের নাম বাঘা যতীন হওয়ার পিছনে রয়েছে একটি দুর্দান্ত কাহিনী । কুষ্টিয়ার কয়া গ্রামে মামার বাড়িতে থাকাকালিন সময়ে ঐ অঞ্চলে বাঘের উৎপাত বেড়ে য়ায়। একদিন গ্রাম সংলগ্ন জঙ্গলে একটি বাঘ আসার খবর রটে যায়। এ খবর পেয়ে যতীন্দ্রনাথ সেখানে উপসি'ত হয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে বাঘের সঙ্গে একাই কুস্তি লড়ায় চালাতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে বাঘকে পরাস্ত করে ভোজালী দিয়ে বাঘটিকে হত্যা করতে সক্ষম হন। আর তখন থেকেই চারিদিকে তিনি বাঘা যতীন নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। বাঘের নির্মম কামড়ে তার দুটি পা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়। কলকাতায় এসে তাকে দীর্ঘদিন ধরে এর চিকিৎসা নিতে হয়েছিল।
এই বাঘা যতীনই স্বদেশ থেকে বেনীয়া ইংরেজ খেদাও আন্দোলনেসর কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই বাংলা থেকে উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত বিস-ৃত ভূখন্ডের ইতঃস্তত বিচ্ছিন্ন সংগঠনগুলো একই কর্মকান্ডের অধীনে আসে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মান সরকারের কয়েক জাহাজ অস্ত্র উপমহাদেশের বিপ্লবীদের জন্য সংগৃহিত হয়। এ অস্ত্রের চালান হস্তগত করার জন্য উড়িষ্যার বালেশ্বর শহর থেকে কুড়ি মাইল দুরবর্তী ময়ুরভঞ্জের জঙ্গলে অবসি'ত নীলভেরী পাহাড় সংলগ্ন দূর্গম এলাকায় কাপ্তিপোদা নামক স'ানে চারজন বিপ্লবী যোদ্ধাসহ অবস'ান গ্রহণ করেন। এরপর মহলদিয়া গ্রামের এক কুঁড়ে ঘরে সাধুবাবা ও চার শিষ্য পরিচয় দিয়ে বসবাস করতে থাকেন। কিছুদিন পর তালদিহা গ্রামে আস্তানা গাড়েন। কিন' অস্ত্রের চালানের খবর ইংরেজ সরকার অবগত হয়ে পড়ায় পথি মধ্যে জাহাজের অস্ত্র ধরা পড়ে যায়। অস্ত্র ধরা পড়ার পর থেকে ইংরেজ পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। এসময় তিনি বালেশ্বর বুড়িবালাম নদীর তীরে একটি পরিখা খনন করে সেখানে সঙ্গীসহ অবস'ান গ্রহণ করেন। যথা সময়ে খবর পৌছে গেলো বৃটিশ পুলিশের কাছে। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৯ সেপ্টম্বর বাঘা যতীনসহ মাত্র ৫জন বিপ্ল্লবীকে দমন করতে রাদার ফেের্েডর নেতৃত্বে শত শত পুলিশ এসে ঘেরাও করে ফেললো পরিখা এলাকা। অনেকক্ষন ধরে চলে গুলি বিনিময়। গুলিতে দেশপ্রেিমক চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী ঘটনা স'লেই নির্মম ভাবে নিহত হন। তারপর হঠাৎ পরপর দুটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় বাঘা যতীনের শরীরে। একটি তলপেটে অন্যটি বাম হাতে। তিনি গুরুতর ভাবে আহত হন। ইংরেজ পুলিশ তাকেসহ গুরুতর আহত অবস'ায় অপর তিন সহযোদ্ধাকে বন্দী করে বালেশ্বর হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরের দিন ভোর বেলায় এখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার লাশ কোথায় কি করা হলো, অদ্যাবিধি তার কোন হদিস পাওয়া সম্ভব হয়নি। মানুষের মুখে অমর হয়ে রইলেন স্বদেশী আন্দোলনের মহান সৈনিক বিপ্ল্লবী বাঘা যতীনসহ তার অসম সাহসী চার বিপ্ল্ল্লবী সাথী। কবির কলমে তা ফুটে উঠলো এভাবে-
“বৃটিশের সাথে যুদ্ধ করেছে
তোমার পঞ্চ বীর।
বুকের রক্তে রাঙায়ে দিয়েছো
বুড়ি বালামের তীর”।
ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু থানার রিশখালী গ্রামের কৃতি সন্তান এই দেশ প্রেমিক বিপ্লবী নেতা স্বাধীন ভারতের সুর্যোদয় না দেখেই ১০ সেপ্টেম্বর ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান। দেশের জন্য জীবন উৎস্বর্গকারী এই মহান বীর মৃত্যুকালে স্ত্রী ইন্দুবালা, কন্যা আশালতা এবং পুত্র তেজেন্দ্রনাথকে রেখে যান। বালেশ্বর হাসপাতালের অদুরে ’চাষাখ-” নামক স'ানে বাঘা যতীনের স্মরনে একটি ম্মৃতি সৌধ নির্মিত হয়েছ্ে। নিজ জ্ন্মভূমি ঝিনাইদহ শহরে এবং মাদ্রাজে বাঘা যতীন নামে সড়কের নাম করন করা হয়েছ্্ে। কলকাতায় বাঘা যতীনের নামে একটি রেল স্টেশনে আছে। কিন' তার পৈত্রিক ভিটা হরিণাকুন্ডু থানার রিশখালি গ্রামে নেই তার নামে কোন ম্মৃতি চিহ্ন। বাঘা যতীনের মুল বসত ভিটা অবহেলিত উপেক্ষিত থাকতে থাকেতে এখন বেদখলে। ভিটার অদুরে ২০১৩ সালে সরকারী অনুদানে বাঘা যতীন ক্লাব নামে একটি সংস'ার ভিত্তি প্রস্তর স'াপন করা হয়েছে। বিশ্ববরন্য এই বিপ্লবী বীরের বসত ভিটা উদ্ধার করে তা যথাযথ ভাবে সংরক্ষনের পাশপাশি বায়া যতীন স্মরনে জনকল্যান মূলক প্রতিষ্ঠান নির্মানের উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
আনোয়ার আলী মিঞা-শিক্ষার এক আলোকবর্তিকা (১৯১৫-১৯৯৮)
আনোয়ার আলী মিঞা ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর হুরিণাকুণ্ডু উপজেলার বেলতলা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ওয়াজির আলী বিশ্বাস বৃটিশ ভারত সরকারের অধীনে রেলওয়েতে চাকুরী করতেন। চাকুরীর শেষ জীবনে ষ্টেশন ম্যানেজার থাকা অবস'ায় অবসর গ্রহণ করেন। ঐ সময় তিনি এন্ট্রাশ পাশ করে চাকুরীতে যোগদান করেন। ওয়াজির আলী বিশ্বাস পারবতীপুরের বনেদী জোয়ারদার পরিবারে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আনোয়ার মিঞার স্ত্রী জোহরা খাতুন তার পিতার প্রথম কন্যা সন্তান ছিলেন।
আনোয়ার মিঞা শিক্ষা লাভ করেছিলেন তৎকালীন নিলফামারী জেলার চিলাহাটী রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকটে জলপাইগুড়ির রাজার প্রতিষ্ঠিত গাতলী সকুলে। পরে তিনি ১৯৩১ সালে সৈয়দপুরে রেলওয়ে হাই সকুল থেকে ম্যাট্রিক ( এসএসসি) প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯৩৪ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আই.এ (এইচএসসি) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতিত্ত্বের সাথে পাশ করেন। অতঃপর কলিকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ১৯৩৭ সনে বি.এ. পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। পড়াশুনা শেষ করে তিনি তৎকালীন বৃটিশ ভারত রেলওয়েতে কলিকাতায় যোগদান করেন। কিছুদিন চাকুরীর পর তিনি সৈয়দপুর রেলওয়ে ষ্টেশনে পোষ্টিং পান এবং পরে আবার কলিকাতায় বদলী হন। তিনি ১৯৩৭ সালের ১০ইং জুন কুষ্টিয়া জেলায় জগতি রেলওয়ে ষ্টেশনের নিকট চৌড়হাস গ্রামে খাঁন বাহদুর আজিজুর রহমানের প্রথম কন্যার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬২ সালের ৯ই মে প্রথম স্ত্রীর বিয়োগের পর তিনি পরের বৎসর পুনঃ বিবাহ করেন। তিনি ৮ ছেলে এবং ৪ মেয়ের জনক ছিলেন। ছেলে মেয়েরা সকলেই নিজ নিজ পেশায় সফল ব্যক্তিত্ব।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কলকাতায় জাপানী বোমা হামলার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় আনোয়ার আলী তার মায়ের অনুরোধে রেলওয়ের চাকুরীতে ইস্তফা দেন। কেননা তিনিই ছিলেন তার মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান। তার পিতাও তখন জীবিত ছিলেন না। তিনি চাকুরী ছেড়ে ১৯৪৩ সালে নিজ গ্রাম বেলতলায় ফিরে আসেন। একই সালে তিনি ঐতিহ্যবাহী জোড়াদহ হাই সকুলে শিক্ষক পদে যোগদান করেন। এখানে তিন বৎসর চাকুরী করার পর তিনি হরিনাকুন্ডু হাই স্কুলে (পাইলট সকুলে) যোগদান করেন। ২ বৎসর চাকুরী করার পর তিনি ১৯৪৮ সালে পুনরায় জোড়াদহ হাই সকুলে ফিরে যান। জোড়দাহ হাই সকুলে পঞ্চাশ দশকের শেষ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। পরে তিনি ১৯৫৯ সালে আবার হরিণাকুণ্ডু হাই স্কুলে যোগদান করে সেখান থেকে আশির দশকে অবসর গ্রহণ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন সৎ, নিরাহংকার, সরলমনা, নির্ভীক, দৃঢ়চেতা ও দুরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন। তার সন্তানদের গ্রাম থেকে ঢাকার খ্যাতিমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে সু-শিক্ষার ব্যবসহা গ্রহণ করেন। যার ফলে তার প্রতিটি সন্তানই জীবনে সফলতার মুখ দেখেন। তিনি শিক্ষা এবং শিক্ষকতাকে জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অসংখ্য কৃর্তি শিক্ষার্থী গড়তে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। হরিনাকুন্ড থানা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও অনেক শিক্ষার্থীর কৃতি জীবন প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা ছিল অগ্রগন্য। একারনে এলাকায় অনেক প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি ইচ্ছা করলে শহরে সরকারী বা আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকুরীতে প্রবেশ করে বিলাসী জীবন যাপন করতে পারতেন। তার আত্মীয় স্বজনগন যে অবস'ানে ছিলেন, সে কারনে তাৰ ভাল মানের কর্মসংস'ানের সমস্যাই ছিল না। কিন' তিনি নিভৃত পল্লী গ্রামে তার সুখ-স্বাচ্ছন্দ ত্যাগ করে শিক্ষার আলোকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়ার মহান আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন। পঞ্চশ দশক অথবা পরবর্তী সময়ের অত্র এলাকায় যাতায়াত সমস্যা, আর্থ-সামাজিক অবসহা এবং সর্বোপরি শিক্ষা গ্রহনের কথা চিন্তাও করতে পারেনি সাধারন জনগন। তখন এসব এলাকার নাম করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জোড়াদহ, হরিণাকুন্ডু, ফুলোহরী স্কুল বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কাঁচা রাস্তা দিয়ে বর্ষাকালে যাতায়াত করতে অসম্ভব কষ্ট শিকার করতে হত। হাঁটা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। তিনিসহ অন্যান্য শিক্ষকরা পায়ে হেঁটে কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সকুলে যাতায়াত করতেন। শিক্ষাকে জীবনের ব্রত হিসাবে না নিলে কারোও পক্ষে এ ধরণের কষ্ট শিকার করা সম্ভব নয়। সন্তানদের সাইকেল কিনে দেওয়ার প্রস্তাবকে কখনোই মেনে নেননি তিনি। তিনি বলতেন, প্রতিদিন হাঁটলে শরীর ভাল থাকে, সুসহ্য থাকে। তাই বেলতলা থেকে হরিণাকুন্ড পর্যন্ত দীর্ঘ ৭ কিলোমিটার পথ ঝড় বৃষ্টি, রোদ উপেক্ষা করে পায়ে হেঁটে সকুলে যেতেন। তখন এলাকার বাইরে যেতে হলে অর্থাৎ ঝিনাইদহ যেতে হলে এই দীর্ঘ পথ হেঁটে / গরুর গাড়ী / ঘোড়ার গাড়ী / মহিষের গাড়ী অথবা সাইকেলে যেতে হতো। আলমডাঙ্গা রেলষ্টেশন বেলতলা থেকে ২০ কিলোমিটার পথ তিনি পায়ে হেঁটেই পাড়ি দিয়ে ট্রেন ধরতেন কুষ্টিয়া, মুন্সিগঞ্জ বা চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার জন্য।
সে সময় লেখা পড়ার পরিবেশ ছিল খুব সুশৃঙ্খল, সুনিয়ন্ত্রিত ও নিয়মিত । তার বড় সন্তান কাদেরুজ্জামান অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত জোড়াদহ মকুলে অধ্যায়নকালে পিতার ছাত্র ছিলেন। তিনি ক্লাসে পড়াশুনার ব্যাপারে কোন ছাড় দিতেন না। সন্তানকেও যথেষ্ট মারধোর করতেন পড়াশুনা গাফলতির কারনে। সকুলে তিনি উপরের ক্লাসেও পড়াশোনা না পারলে শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। যা কিনা আজকে ছাত্ররা কল্পনাও করতে পারে না। সে সময়ের ভায়নার বদরুল সা্যর, রামনগরের আজিজ স্যার, আনোয়ার স্যার কিভাবে ক্লাসে ছাত্রদের পড়াতেন এবং তাদের থেকে পড়া আদায় করে নিতেন সেটি এখন রীতিমত ইতিহাস হয়ে আছে। তিনি কঠোরতা ও কোমলতার পরশে ছাত্রদের আপন করে নিতে পারতেন পিতার মত করে।
আনোয়ার আলী মিঞা ইংরেজী, অংক, ইতিহাস ও ভূগোলের জ্ঞান তৎকালিন সময়ের ছাত্রদেরকে অবাক করে দিত। ইংরেজী ও অংকে পারদর্শীতা এতদাঞ্চলে তাকে বিশেষ মহিমা দান করেছিল। তিনি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে অনেক মেধাবী ছাত্রদেরকে ঘবংভরবষফ এর ইংরেজী গ্রামার, যাবদ চক্রবর্তীর পাটীগণিত ও কে,পি বসুর এ্যালজাবরা শেষ করে দিতেন।
তিনি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ছিলেন। সব সময় আত্মীয় স্বজনের সুখ দুঃখের খবর নিতেন এবং সর্বদা তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। সহানীয় রাজনীতিতেও একসময় তিনি স্বক্রিয় ছিলেন। একাধিকবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান / মেম্বার হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি জমির বর্গাদারদের প্রতি ছিলেন খুবই সহানুভূতিশীল। কোন বছর ঠিকমত ফসল না হলে ফসলের অংশ ছেড়ে দিতেন। সাধারণ লোকের সঙ্গে মেশার তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। কিন' স্পষ্টভাষনের জন্য তিনি অনেক সময় ভুল ভাবে চিত্রায়িত হতেন। তিনি কোন হাঙ্গামা পছন্দ করতেন না । তাই তার ৬০ বিঘা জমির বিরুদ্ধে হরিশপুরের এক সহানীয় ব্যক্তি কোর্টে মামলা করলে ৩৫ বৎসর তিনি মামলা চালিয়ে গেছেন। কিন' সহানীয় লোকজন দ্বারা তাকে কোন সময় অপদসহ হতে দেননি। দীর্ঘ সময় মামলা পরিচালনা করে বিজয়ী হয়ে তবেই এই জমির দখল তিনি বুঝে নিয়ে ছিলেন।
তার প্রায় ৮৫ (পচাঁশি) বৎসরের জীবন ইতিহাস খুব বৈচিত্র পূর্ণ। জীবনে তিনি অনেক কষ্ট করেছেন। নিজের সুখ শান্তি ত্যাগ করেছেন। অস্বাভাবিক পরিসিহতি মুকাবেলা করেছেন শুধু সন্তান শুভাক্ঙ্ক্ষীদের ভবিষ্যতের শিক্ষা, সুখ, শান্তি ও জীবনের প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য। তিনি দুরারোগ্য লিভার ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৮ সালের ২৭শে মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মহান প্রভুর পাড়ি জমান। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। এসময় তিনি নিজ গ্রামের পারিবারিক কবর স'ানে দাফনের জন্য অসিয়ত করেন। তার অসিয়ত অনুযায়ি তাকে বেলতলা গ্রামের পারিবারিক কবর স'ানে সমাধিসহ করা হয়।
জ্ঞান তাপষ মাস্টার আজিজুর রহমান-(১৯১৭-২০১২)
আজিজুর রহমান ( আজিজ মাস্টার) ১৩২৯ বঙ্গবাদে ২১ বৈশাখ বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার রামনগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা দানেস আলী বিশ্বাস তৎকালিন সময়ে শিক্ষিত এবং সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মাতা আজিরন নেসাও স্বশিক্ষিত এক মহিয়সী রমনী ছিলেন্।
শিক্ষা জীবন ঃ প্রাথমিক শিক্ষাঃ ১৯৩১-১৯৩৪ সাল ভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় (১ম শ্রেণী হতে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত)।
নিম্ন মাধ্যমিক - ১৯৩৫-১৯৩৬ সাল হরিণাকণ্ডু এম.ই স্কুল ( ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত)
মাধ্যমিক শিক্ষা- ১৯৩৭-১৯৪০ সাল ফুলহরি হাই স্কুল (৭ম শ্রেণী হতে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত এবং ঐ স্কুলের খ্যাতিমান ছাত্র হিসাবে উত্তীর্ণ (বৃহত্তর যশোর জেলার ৩ জন ডিস্ট্রিংশন প্রাপ্তদের মধ্যে একজন তিনি।)
অন্যান্য গবেষণাঃ কলকাতা অবস'ান কালেই ১৯৪২-১৯৪৩ সালে সুফীবাদ, সন্ন্যাসবাদ ও বাউল ধর্মের উপর নতুলনা মূলক প্রচুর লেখাপড়া ও গবেষণা চালান ।
অন্যান্য সাফল্যঃ কলকাতা ক্রীড়াঙ্গনে তার বিচরন ছিল উল্লেখ করার মত। প্রেসিডেন্সী কলেজ ফুটবল টিমের অন্যতম ফুটবলার হিসাবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। কথিত আছে তাঁর ডাইরেক্ট কিক্ নিকট থেকে মোকাবলা করার সাহস কারো ছিল না। প্রচন্ড গতিতে তিনি কিক্ দিতে পারতেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত উভয় বাংলা সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১ম স'ান অধিকার করেছিলেন। এ ছাড়াও আরও অনেক কৃতিত্ব অজানা রয়ে গেছে ( প্রচার বিমুখিতার কারনে যা বলতে চাননিা)।
কর্মজীবন ঃ ১৯৪৩ সালে বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে টিএন্ডটি বিভাগে শিয়ালদাহে যোগদান করেন। পরে উক্ত চাকরিতে ইস্তফা দেন। ১৯৪৪ সালে পার্বতীপুর জুনিয়র মাদরাসায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান এবং ১৯৪৫ সালের ১৬ই জানুয়ারী পার্বতীপুর হাই স্কুলের জন্ম লগ্ন হতে অংক ও ভূগোলের স্বনামধন্য শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর জোড়াদহ হাই স্কুলে যোগদান করে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় এখানেই অতিবাহিত করেন। এরপর ১৯৬৭-৬৮ সালে আবারও পার্বতীপুর হাই স্কুলে ফিরে এসে বেশ কয়েক বছর এখানে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৭২-৭৩ সালে আবারও জোড়াদহ হাই স্কুলে প্রত্যাবর্তন এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত জোড়াদহ হাই স্কুলে দায়িত্ব পালন কালে অবসর গ্রহণ করেন। সুদীর্ঘ ৫৩ বছর শিক্ষকতা পেশায় অতিবাহিত করেন। তাঁর অসংখ্য কৃতিমান ছাত্র-ছাত্রী দেশে -বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন।
পারিবারিক জীবন ঃ ১৯৪৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ১০ পুত্র ও ৫ কন্যার জনক। পুত্রদের মধ্যে অনেকেই সরকারী/আধা-সরকারী সংস'ায় পদস' কর্মকর্তা হিসেবে সুনামের সাথে কর্মরত আছেন।
গবেষণা ও ধর্মপ্রচার ঃ মাস্টার আজিজুর রহমান তাঁর পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম বিষয়ে ব্যাপক পড়ালেখা ও গবেষণামূলক কাজ চালিয়ে যান। তাঁর লেখা ছোট-বড় ৯ খানা পুস্তক/পুস্তিকার পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। নিজে প্রচার বিমূখ হওয়ায় তা প্রকাশিত হয়নি। অচিরেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) স্বভাবিক মানুষ রাসুল বইটি প্রকাশিত হবে বলে আশা করা যায়। তিনি দীর্ঘদিন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে হরিণাকুণ্ডু, শৈলকুপা ও বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্ম প্রচার করেছেন। সভা-সমিতি ও ওয়াজ-মাহফিলে তিনি অনলবর্ষী বাগ্মিতার অধিকারী ছিলেন। ধর্ম বিষয়ে যুক্তি-তর্কেও তিনি ইসলাম ধর্মের মৌলিকত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন বলে কথিত আছে। কিছুদিন তিনি কুষ্টিয়াস' সর্ব ধর্ম গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন।
শেষ জীবনঃ বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি নিজ গ্রামের বাড়ীতে কয়েক বছর শয্যাশায়ী অবস'ায় দিন যাপন করেন। কিছুটা স্মৃতিভ্রম হলেও অনেক বিষয়ে তখনও ভাল মত বলতে পারতেন। কিন' নিজে প্রচার বিমূখ হওয়ার কারণে সব কথা বলতে চাননি। মতাদর্শগত মিল খুঁজে পেলে তার সাথেই কেবল মন খুলে কথা বলতেন। বেশীর ভাগ সময় চুপচাপ থাকতে ভালবাসতেন। শেষ জীবনে বার্ধক্যজনিত রোগে কিছুদিন অসুস'্য থাকার পর অবশেষে ২০ডিসেম্বর ২০১২ সালে ইহজাগতিক মায়া ত্যাগ করে মহান প্রভুর দরবারে পাড়ি জমান।
লেখক-সাহিত্যিকঃ ড.খোন্দকার রিয়াজুল হক (লালন গবেষক), খোন্দকার রফি উদ্দীন (ভাব সঙ্গীত গ্রন্ত্রের রচয়িতা), খোন্দকার কেরামত আলী (প্রাবান্ধিক), আলী হাবিব (কলামিষ্ট ও রম্য লেখক), আশরাফুল ইসলাম (কলামিষ্ট ও প্রাবন্ধিক), টিপু সুলতান বারী ( কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক) , টোকন ঠাকুর (কবি), মোসলেম উদ্দীন ( কবি ও প্রাবন্ধিক), আব্দুল্লাহ মাসুদ ( কবি ও প্রাবন্ধিদক) আব্দুল্লাহ মারুফ ( কবি), সোহেল এইচ রহমান ( ছোট গল্প ও স্মুতিকথা), খোদা বখ্স ( কবি, ছোট গল্পকার) অনির্বান খালিদ ( কবি) মাহবুব মুরশেদ ( প্রাবন্ধিক ও গবেষক) এনামূল হক (কবি), শামসুলর আলম টুকু(কবি), শাহনেওয়াজ আলম মিঠু ( কবি), মতিয়ার রহমান (কবি)।
সাংবাদিকঃ আলী হাবিব (কালেরকণ্ঠ), আশরাফুল ইসলাম (দৈনিক ইত্তেফাক), ইমদাদুল হক বিশ্বাস ( রূপালী বাংলাদেশ) মাহবুব মুরশেদ (নয়াদিগন্ত), সাইফুজ্জামান ( মানবজমিন), মাহফুজুর রহমান (বাংলাদেম সময়), শাহানুর আলম (দৈনিক ইত্তেফাক), নাজমূল আহ্সান ( নিউজ টুডে), এইচ, মাহবুব মিলু (নতুন বার্তা), আহ্সান হাবিব, রবিউল ইসলাম (করতোয়া) সাইফুল ইসলাম( সময়ের কাগজ), মোস্তাফিজুর রহমান ( ঝিনাইদহ ২৪ ডটকম), তৈয়বুর রহমান (আরশীনগর), সৌরভ হোসাইন (নতুন খবর), বিপ্লব হোসাইন (রূপালী বাংলাদেশ), জাফিরুল ইসলাম ( আমাদের সংবাদ) ।
লেখকঃ শিক্ষক ও গবেষক।
তথ্য সূত্রঃ
ক) জেলা-উপজেলা প্রশাসনের ওয়েব সাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য।
খ) হরিণাকুণ্ডু নামের ইতিকথা।
গ) এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত তথ্য।
ঘ) বাংলা পিডিয়া প্রকাশিত তথ্য।
ঙ) বাউল কবি লালন শাহ- ড. আনোয়ারুল করিম।
চ) লালন পরিচিতি অধ্যাপক আবু তালিব।
ছ) লালন শাহ জীবন ও গান- ড. এসএম লুৎফর রহমান।
জ) মরমী কবি পাঞ্জু শাহ- জীবন ও কাব্য- ড. খোন্দকার রিয়াজুল হক ।
ঝ) লালন শাহের পূন্যভূমি হরিশপুর- ড. খোন্দকার রিয়াজুল হক।
ঞ) লালন অনুগামী দুদ্দু শাহ- কুস্টিয়া সরকারি কলেজ কর্তৃক প্রকাশিত সাহিত্য ম্যাগাজিন ।
ট) লালন- ১২৬তম তিরোধান বার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা।
ঠ) লালন-১২৭তম তিরোধান বার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা।
ড) চরিতাভিধান- বাংলা একাডেমী।
ঢ) ঝিনাইদহের ইতিহাস- জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত।
ণ) ১৯৭১ ঝিনাইদহের রনাঙ্গন-সুমন শিকদার সম্পাদিত।
ত) ঝিনাইদহের লিখিয়েরা-হাশিম মিলন।
থ) লালন ভূমি পত্রিকা- মোসলেম উদ্দীন সম্পাদিত।
দ) একুশের ভোর সামযিকী।
ধ) মাহে নও পত্রিকা ভাদ্র সংখ্য-১৯৫৩।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন